জালালউদ্দিন রুমি একজন পার্শিয়ান কবি এবং সুফী রহস্যবাদী। তাঁর পুরো নাম হচ্ছে জালালউদ্দিন মুহম্মদ বলখি । তবে তিনি মাওলানা রুমি, মৌলভি রুমি,রুমি নামেও পরিচিত। তিনি ১৩শ শতাব্দীর একজন ফার্সি সুন্নি মুসলিম কবি, আইনজ্ঞ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্ত্বিক, অতীন্দ্রিয়বাদী এবং সুফী ছিলেন।
রুমির প্রভাব তাঁর দেশের সীমানা এবং জাতিগত পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে বিশ্বদরবারে সমাদৃত হয়েছে। ফার্সি, তাজাকিস্তানি, তুর্কি, গ্রিক, পশতুন, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলামানরা বিগত সাত শতক ধরে বেশ ভালভাবেই তার আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারকে যথাযথভাবে সমাদৃত করে আসছে। এছাড়াও বর্তমানে ইউরোপ–আমেরিকা ছাড়া প্রাচ্যের দেশগুলোতেও রুমির কবিতা খুবই পাঠকপ্রিয়। কারণ, তাঁর কাব্যের প্রতিটি চরণে রয়েছে অধরা এক উপলব্ধির পৃথিবী।
তিনি তাঁর মসনবী শরীফে যা লিখেছেন তা অনবদ্য। তার কবিতা ও এর শব্দ এর মধ্যে রয়েছে জাদু, ভালোবাসা ও গভীর প্রজ্ঞা।
আজকে আমি আপনাদের সাথে মাওলানা রুমির ব্যক্ত ২৫ টী উক্তি ও তাঁর ব্যাখ্যা করবো যা জীবনকে করবে আরও সুন্দর, পরিপূর্ণ ও অর্থপূর্ণ।
১. ক্ষুদ্র পদক্ষেপ নেওয়া বন্ধ করো ।
তুমিই হলো এ মহাবিশ্ব যে উল্লসিত গতিতে প্রবাহিত হচ্ছে।
তোমার জন্মই হয়েছে অবারিত শক্তি নিয়ে। তোমার মাঝেই সবকিছু রয়েছে।
আর তুমি কীনা নিজেকে দূর্বল ভেবে তা অবহেলা করছো। তোমার রয়েছে ডানা। একে ব্যবহার করো ওড়ার জন্য। তোমার ভেতরে রয়েছে স্বর্ণের খন্ড যা পুড়ে খাঁটি হওয়ার জন্য আকুলি বিকুলি করছে। তাই তোমাকে কয়েন হবার কোন প্রয়োজন নেই।
তোমার কাছে তো রশি রয়েছেই, তাহলে তুমি কুয়োর নিচেতে কী করছো!! উঠে এসো!! আকাশ হয়ে ওঠো। একটি কুঠার হাতে নাও ও কারাগার ভেঙ্গে বের হয়ে এসো। কেননা তুমিই এ মহাবিশ্ব, এ বিশ্বজগৎ তোমারই।
২. নিজের জন্য বেঁচে থাকো।
তোমার কাজ হলো এমনভাবে নিজের জীবনকে যাপন করা যা তোমার নিজের কাছে অর্থপূর্ণ বলে মনে হয়, অন্য মানুষদের কাছে নয়।
তাই নূহের তরী তৈরী করার মত বিশাল কাজ অন্যের কাছে বোকামিপূর্ণ মনে হলেও এতে কিছু যায় আসে না।
৩. হাল ছেড়ে দিও না।
যখন তুমি প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাও, সবকিছুই তোমার বিপরীতে অবস্থান করে, যখন তুমি আর এক মিনিটও যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছো না, সেই মুহূর্তে হাল ছেড়ো না। এটাই হল সেই সময় যে সময়ে তোমার যন্ত্রণার বিপরীত নতুন কিছু ঘটবে। এটা সেই সময় যেই সময় পুরান পাতাগুলো ঝড়ে পড়ে গিয়ে নতুন পাতা জন্মাবার রাস্তা তৈরী হয়। তাই হাল ছেড়ে দিয়ো না।
বরং নাচো! যখন তুমি পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছো। কারণ আগুনে পুড়েই স্বর্ণ খাঁটি হয়।
৪. অজ্ঞতা হল খোদার জেলখানা।
“অজ্ঞতা হল খোদার জেলখানা। আর জ্ঞান হল খোদার আরশ।”
৫. “তোমার ভেতর রয়েছে ঝর্ণাধারা। শুধু শুধু খালি বালতি নিয়ে ঘুরঘুর করো না।”
“কেন এই পৃথিবীর মোহমায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছো! যেখানে তোমার কাছে রয়েছে স্বর্ণের খনি।”
“তুমি এ ঘর থেকে ও ঘর দৌড়ে বেড়াচ্ছো হিরার গহনার জন্য যেটা কীনা তোমার নিজের গলাতেই ঝোলানো রয়েছে।”
৬. যখন তুমি আসলে কী তা ভারমুক্ত করে দাও তখন তুমি তাই হয়ে ওঠো যা তোমার হওয়া সম্ভব।
“বিগলিত তুষার হয়ে যাও। নিজেকে শুদ্ধ করো নিজেকে থেকে।”
“নিরাপত্তার কথা ভুলে যাও। যেখানে তুমি ভয় পাও সেখানেই বাস করো। নিজের মান-মর্যাদা কে ধ্বংস করে ফেলো। কুখ্যাত-এর মত জীবনযাপন করো।”
“নিজের জীবনকে আগুনের মাঝে ফেলে দাও। তাদের খোঁজ করো যারা তোমার আগুন শিখার অনুরাগী।”
৭. তোমার জন্য অবশ্যই কিছু না কিছু রয়েছে যা তুমি অন্যদের থেকে ভালো করতে পারো।
“প্রত্যেককেই তার আলাদা আলাদা কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং সে কাজ সম্পাদনের জন্য সমস্ত হৃদয় দিয়ে আকাঙ্খা করতে হয়।”
৮. তোমার পুরো সমস্ত সিঁড়ির ধাপ দেখার দরকার নেই, কেবলমাত্র প্রথম ধাপটিতে অগ্রসর হও।
“যখন তুমি রাস্তার উদ্দেশ্যে পথ চলা শুরু করবে তখন রাস্তা হাজির হয়ে যায়।”
একটি মানুষ তার ছোট ছোট পদক্ষেপ নেবার মাধ্যমে পরবর্তীতে গিয়ে বিশাল কর্ম করে ফেলে৷ তাই বিশাল কাজ দেখে ভড়কে যাবার কিছু নেই। শুধুমাত্র প্রথম পদক্ষেপের কথা মাথায় রেখে পথ চলা শুরু করলে বিশাল কাজও সহজ হয়ে আসে এবং রাস্তাও আপনা আপনি ধরা দেওয়া শুরু করে।
৯. যখন তুমি কোনকিছু করতে মনস্থ করো তখন তা সমস্ত হৃদয় দিয়ে করো।
আমরা যা কিছুই করি না কেন তা পূর্ণতার সাথে করা উচিত। তবেই আমরা আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো।
১০. ভালো কিছু ফুরিয়ে আসে যাতে সে জায়গায় আরও ভালো কিছু যুক্ত হতে পারে।
“হতাশ হয়ো না। তুমি যা কিছুই হারিয়েছ না কেনো তা ঘুরেফিরে অন্যকোন রূপে তোমার কাছে ফিরে আসবে।”
১১. আঘাতপ্রাপ্ত স্থানই হল সে জায়গা যেখান দিয়ে আলো তোমার মাঝে প্রবেশ করে।
“তোমাকে তোমার হৃদয়কে প্রতিনিয়ত আঘাত করে যেতে হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি না খোলে।”
“হতাশা করুণার সুন্দর বাগানে পরিণত হতে পারে। যদি তুমি তোমার হৃদয়কে সম্পূর্নরূপে খোলা রাখতে পারো, তাহলে তোমার ব্যাথাও তোমার চরমবন্ধুতে পরিণত হতে পারে ভালোবাসা ও প্রজ্ঞা অনুসন্ধানের রাস্তায়।”
১২. তুমি যা ভালোবাসো তাই-ই করো এবং তা ভালোবাসার সহিত করো।
“নিজেকে তোমার ভালোবাসার বিষয়বস্তুর তীব্র টানের কাছে নিঃশব্দে সমপর্ণ করে দাও।”
“সৌন্দর্য সেটাই হোক যা আমরা ভালোবাসি এবং আমরা সেভাবেই তা হয়ে উঠি।”
১৩. চিন্তা কম করো। অনুভব করো বেশী।
“ভালোবাসার কাছে যুক্তি শক্তিহীন।”
“একমাত্র হৃদয় দিয়ে তুমি আকাশকে ছুঁতে পারবে।”
“চিন্তাশূন্য হও। চিন্তা করো কে এই চিন্তাকে তৈরী করেছে! কেন তুমি এই জেলের মাঝে বন্দী রয়েছো যেখানে মুক্ত দরজা রয়েছে?”
১৪. ভালোবাসা হল সবচেয়ে দামী।
“ভালোবাসার জন্য সবকিছুকে বাজী রাখো যদি তুমি প্রকৃত মানুষ হয়ে থাকো। আর তা যদি না হয় এর পেছনে ছোটা বন্ধ করে দাও।”
১৫. তোমার জীবনে ভালো এবং খারাপ উভয়কেই গ্রহণ করতে শেখো।
“যদি তুমি প্রতিটি ঘর্ষণে বিরক্ত অনুভব করো, তাহলে কীভাবে তুমি উজ্জ্বল হবে?”
“যখন কেউ একটি গালিচাকে আঘাত করে, সেই আঘাত আসলে গালিচার বিরুদ্ধে নয় বরং তাতে লেগে থাকা ধুলাবালির বিরুদ্ধে।”
১৬. নিজেকে বদলে দাও, তাহলে পৃথিবীও বদলে যাবে।
গতকাল আমি চালাক ছিলাম, তাই আমি পৃথিবীকে বদলাতে চেয়েছিলাম। আজ আমি জ্ঞানী, তাই আমি নিজেকে পরিবর্তন করছি।
১৭. আমরা ভালোবাসা থেকে ও ভালোবাসার জন্য তৈরী হয়েছি।
“ভালোবাসর মাধ্যমেই সকল তিক্ততা মিষ্টতায় পরিবর্তিত হয়ে যায়,
ভালোবাসার মাধ্যমেই সকল তামা স্বর্ণে রূপান্তরিত হয়,
ভালোবাসার মাধ্যমে সকল তলানী মদে পূর্ণ হয়ে যায়,
ভালোবাসার মাধ্যমে সকল ব্যাথা ওষুধে পরিণত হয়ে যায়।”
“আমাদের জন্ম হয়েছে ভালোবাসা থেকে। ভালোবাসাই হল আমাদের মাতৃস্বরূপ।”
১৮. তোমার আত্মা এই পৃথিবীর নয়, এটা হল তোমার দেহ।
“যখন আমি মরে যাবো তখন আমি ফেরশতাদের সাথে উর্ধ্বে গমন করবো এবং যখন আমি ফেরশতাদের কাছে মরে যাবো তখন আমি যাতে পরিণত হব তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”
১৯. আত্মার স্তরে আমরা সবাই এক।
“সকল ধর্মের মাঝে একটি সুরই বেজে চলেছে। পার্থক্য মোহ ও অন্তঃসারশূন্যতা ব্যতীত আর কিছুই নয়। সূর্যের আলো একটি দেয়ালে পড়লে তা আলাদা লাগে অন্য কোন দেয়ালে পড়া আলোর থেকে। কিন্তু এটা তবুও সেই একই আলো।”
“আমি আর কীইবা বলব, ও মুসলমানেরা, আমি নিজেকে জানি না, আমি নই কোন খ্রিস্টান, নই কোন ইহুদী, নই কোন জরথুস্ত্রীয়ান, নই কোন মুসলিম।”
২০. তোমার আত্মা অন্য যেকোন কিছুর চেয়ে অধিক মূল্যবান।
“তুমি ব্যাবসার প্রতিটি বস্তুর মূল্য সম্পর্কে অবগত আছো, কিন্তু যদি তুমি তোমার আত্মার মূল্য সম্পর্কে না জানো, তাহলে এটা সবই বোকামী।”
২১. তোমার সঙ্গী কে বুদ্ধিমত্তার সহিত নির্বাচন করো।
“এমন কাউকে বেছে নাও যে সবসময় অর্জন করতে চাইবে না, ধনসম্পত্তির প্রতি লালায়িত হবে না অথবা তা হারিয়ে যাবার ভয় করবে; এমনকী যার নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগ্রহ থাকবে নাঃ সেই হল মুক্ত।”
২২. সত্যিকার ভালোবাসা এই বস্ততান্ত্রিক জগতকে অতিক্রম করে যায় এবং যদি শরীরও এটি হতে আলাদা হয়ে যায় এটা কোন বিষয় নয়, তোমার আত্মা চিরন্তন সংযুক্ত হয়ে থাকবে।
“বিদায় শুধু তাদের জন্য যারা কেবল তাদের চোখ দিয়ে ভালোবেসেছে। কেননা যারা তাদের হৃদয় এবং আত্মা দিয়ে ভালোবেসেছে তাদের কাছে আলাদা হয়ে যাওয়া বলে এমন কোন বিষয় নেই।”
২৩. নিজের শব্দকে জাগিয়ে তোলো, তোমার কন্ঠকে নয়।
“তোমার শব্দকে জাগিয়ে তোলো, কন্ঠকে নয়। এটা বৃষ্টি যা ফুলের জন্ম দেয়, বজ্রপাতের নয়।”
২৪. নিঃশব্দতা হল খোদার ভাষা।
“নিঃশব্দতা হল খোদার ভাষা, বাকীসব হল বাজে অনুবাদ।”
“শব্দ হল একটি অজুহাত। এটা হল আন্তরিক বন্ধন যা পরস্পরকে কাছে টানে, শব্দ নয়।”
২৫. শুধুমাত্র জীবিত থাকা যথেষ্ট নয়।
“তুমি চিন্তা করো যে তুমি জীবিত আছো কেননা তুমি বায়ু গ্রহণ করছো? তোমার প্রতি ধিক্কার, যে তুমি এত ছোট পরিসরে জীবিত আছো। ভালোবাসা ছেড়ে এমনটা হয়ে যেয়ো না, এতে তুমি নিজেকে মৃত বলে অনুভব করবে না। ভালোবাসাতে মরো এবং অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকো।”