দ্যা হোপ এক্সপেরিমেন্ট-আশা ও বিশ্বাসের শক্তি

১৯৫০ এর দশকে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী ডা. কার্ট রিখটার দ্যা হোপ এক্সপেরিমেন্ট বা বিশ্বাস পরীক্ষা নামক বিখ্যাত একটি পরীক্ষা করেছিলেন।

এই পরীক্ষাতে অধ্যাপক ডুবন্ত ইঁদুরের মনস্তত্ব পরীক্ষা করেছিলেন। পরীক্ষাটি করতে অধ্যাপক পানি, বালতি এবং ইঁদুরের ব্যবহার করেছিলেন।

এই পরীক্ষাতে তিনি গৃহপালিত ও বন্য দুই ধরণের ইঁদুর ব্যবহার করেছিলেন।

এই হোপ এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে মনোবিজ্ঞানের এক অনবদ্য আবিষ্কার করেছিলেন ডা. কার্ট রিখটার।

ডুবন্ত ইঁদুরের মনস্তত্ব পরীক্ষাঃ

ডা. কার্ট পানি ভর্তি বালতিতে ইঁদুর ছেড়ে দিয়েছিলেন। মূলত তিনি পরীক্ষা করছিলেন একটি ইঁদুর ডুবে যেতে কতক্ষণ সময় নেয় এবং কতো সময় পর মারা যায়।

বিভিন্ন ভাবে ও বহুবার তিনি এই পরীক্ষাটি করেন। যদিও তাঁর মূল পরীক্ষাটি করা হয়েছিলো তিন ধাপে।

কখনো তিনি বাসা বাড়িতে যে ইঁদুর থাকে তা দিয়ে ও কখনো বন্য ইঁদুর দিয়ে এই পরীক্ষা করেন।

যদিও আপাত দৃষ্টিতে এই পরীক্ষাটি খুবই নিষ্টুর মনে হচ্ছে কিন্তু এর ফলাফল খুবই আশাব্যঞ্জক ছিলো।

গৃহপালিত ইঁদুরঃ

বিজ্ঞানী প্রথম ধাপে ১২ টি পোষা ইঁদুর ব্যবহার করেছিলেন। এই ইদুরগুলির প্রথমটিকে যখন তিনি বালতির পানিতে ছেঁড়ে দেয়, তখন সে ইঁদুরটি প্রথমে বালতির পৃষ্ঠের চারপাশে সাঁতার কাটতে থাকে এবং তারপর সে বালতির তলদেশে কি আছে তা কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে এবং পুনরায় ভেসে উঠে।

এভাবে ইঁদুরটি দুই মিনিট পর্যন্ত ভেসে থাকতে পারে এবং দুই মিনিট পর সে হাল ছেঁড়ে দেয়। যার দরুন সে ডুবে যায় ও মারা যায়।

অন্যান্য ইঁদুরগুলির মধ্যে দুটি মোটামুটি একই কাজ করেছিলো এবং একই সময়ের জন্য বেঁচে ছিলো।

তবে মজার ব্যাপার হলো, বাকি নয়টি ইঁদুর সম্পূর্ণ ভিন্ন কাজ করেছিলো। প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর তারা সাঁতার কাটতে থাকে বালতিতে ঘুরে ঘুরে।

হাল ছাড়ার আগে ইদুরগুলি প্রায় একদিনের মত সাঁতার কেটেছিলো এবং তারপর ডুবে গিয়ে মারা যায়।

 

বন্য ইদুরঃ

 

 

দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষাতে ডা. কার্ট রিখটার ৩৪টি বন্য ইঁদুর নিয়েছিলেন।

বন্য ইদুরগুলি ছিল দুর্দান্ত সাঁতারু বর্বর ও আক্রমণাত্মক। স্বভাবতই তারা বন্য প্রকৃতিতে টিকে থাকতে বিভিন্ন কুট কৌশল ও হিংস্রতা রপ্ত করেছিলো।

স্পষ্টতই বিজ্ঞানী তাদের বেঁচে থাকার জন্য কঠোর লড়াই প্রত্যাশা করেছিলো।

কিন্তু ফলাফল ছিলো খুবই আশ্চর্যজনক। বর্বরতা,হিংস্রতা,টিকে থাকার সক্ষমতা,সাঁতার কাটার যোগ্যতা ইত্যাদি বন্য যোগ্যতা থাকা স্বত্তেও ৩৪টি ইঁদুরের একটিও কয়েক মিনিটের বেশি বেঁচে ছিলো না।

 

দ্যা রোল অফ হোপ বা আশার ভূমিকাঃ

অধ্যাপক ডা. কার্ট রিখটার দুই ধাপের পরীক্ষার পর, কেনো কিছু ইঁদুর সহজে হাল ছেঁড়ে দিয়েছিলো এবং কেনো কিছু ইঁদুর অনেকবেশি চেষ্টা করেছিলো টিকে থাকার তাঁর একটি হাইপোথিসিস দাড় করালেন।

তাঁর হাইপোথিসিস অনুযায়ী, যেসকল ইঁদুর টিকে থাকার লড়াই চালিয়েছিলো তারা অতীতে কোনও না কোনও সময় যখন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলো তখন কারো সহোযোগিতা পেয়েছিলো এবং বিপদ মুক্ত হয়েছিলো। তাই সেই ইঁদুর গুলোর মনে আশা ছিলো এবারও কোনো না কোনোভাবে বেঁচে যাবার। তাই তারা সাঁতার কাটতে থাকে বেঁচে থাকার আশায় ও সাহায্য পাওয়ার আশায়।

অন্যদিকে যে ইঁদুরগুলো অল্প কয়েক মিনিট মাত্র বেঁচে ছিলো তাদের আসলে কোনো আশা ছিলো না সহোযোগিতা পাবার। তাই তারা খুব সহজেই হাল ছেঁড়ে দিয়েছিলো।

এই হাপোথিসিসের দরুন অধ্যাপক সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি পুনরায় পরীক্ষা করবেন।

আশা ও সহোযোগিতার সাথে পরিচয়ঃ

 

পরীক্ষার শেষ ধাপে বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. কার্ট রিখটার তাঁর হাইপোথিসিস অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন, তিনি ইঁদুরদের সাথে আশা ও সহযোগিতার পরিচয় ঘটাবেন এবং এর মাধ্যমে ইঁদুরদের বেঁচে থাকার জন্য যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার মানসিকতা বৃদ্ধি পাবে।

তাই তিনি তাঁর অনুমান পরীক্ষা করার জন্য ইঁদুরদের একটা নতুন দল বেছে নেন। এই ইঁদুরগুলো একটি অন্যটির সমান এবং একই বয়সি ছিলো।

তিনি ইঁদুরগুলোর প্রত্যেকটিকে আলাদা আলাদা করে পূর্ববর্তী সময়ের মতো পানি ভর্তি পাত্রে ছেঁড়ে দেন এবং ঠিক যেই মুহূর্তে ইঁদুর হাল ছেঁড়ে দেয় ও ডুবে যেতে যায় তখন তিনি ইদুরটিকে পাত্র থেকে তুলে ফেলেন। তারপর ইঁদুরটিকে শুঁকিয়ে ফেলেন।

কিছুসময় পর তিনি পুনরায় ইঁদুরটিকে পানি ভর্তি পাত্রে ছেঁড়ে দেন।

এবার তিনি দেখতে পান তাঁর অনুমান সঠিক ছিলো। যখন ইঁদুরটিকে পানি ভর্তি পাত্রে রাখা হয় সে সাঁতার কাটতে থাকে এবং আগের তুলনায় বেশিসময় ধরে পাত্রে রাখার পরও ইঁদুরটি ডুবে যায় না এবং সে অনবরত সাঁতার কাটতেই থাকে।

এভাবে পর্যায়ক্রমে সবকয়টি ইঁদুরকে পরীক্ষা করা হয় এবং ধাপে ধাপে সময় বাড়িয়ে দেখা যায় তারা হাল ছেঁড়ে দিচ্ছে না।

কারণ তাদের এখন আশা আছে বেঁচে থাকার ও সহযোগিতা পাবার।

ঠিক যেই মুহূর্তে তাদের ডুবে যাবার কথা সে মুহূর্তে সে আশা করে এইতো আর কিছুক্ষণ সাঁতার কাটলেই সে বেঁচে থাকবে এবং তাকে তুলে নেয়া হবে।

এই পরীক্ষার পর ডা. কর্ট লিখেছিলেন –

The rats quickly learn that the situation is not actually hopeless and that after elimination of hopelessness the rats do not die.”

অর্থঃ ইদুরগুলো খুব দ্রুত বুঝতে পারে পরস্থিতি এতোটাও হতাশাজনক নয় এবং হতাশার পরিসমাপ্তি ঘটলে ইঁদুরগুলো আর মারা যায় না।

মানবজীবনে হোপ এক্সপেরিমেন্টের প্রতিফলনঃ

মানুষ ও ইঁদুর একবারেই আলাদা প্রাণী। তবুও এই পরীক্ষা থেকে আমাদের শিক্ষণীয় আছে।

মানুষের জীবনের মূল চালিকা শক্তির ভিত অনেকাংশেই আশার উপর নির্ভরশীল।

যেখানে মানুষের আশা আছে সেখানে মানুষের অধ্যাবসায় ও চেষ্টার প্রতিফলন ঘটে সহজে। মানুষ লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে আশার ডানায় ভর করে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। মানুষের ভাবনায় থাকে তখন , আমাদের প্রচেষ্টা সাফল্যের বা প্রতিকূলতার থেকে উদ্ধারের সুযোগ।

আশা আছে তাই মানুষ বাঁচে। যদি আশা না থাকতো তবে মানুষের ভিতর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইচ্ছা হতোনা,হতাশায় আচ্ছাদিত হয়ে বেশিদিন টিকে থাকতে পারতোনা।

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আশা ও বিশ্বাস মানুষকে সামনের দিকে চালিত করে।

এমনকি কর্মক্ষেত্রেও আমাদের এই হোপ এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল সহায়ক। এর ফলাফল থেকে আমরা শিখি যে আমাদের দৃঢ়চেতা হতে হবে এবং যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে দৃঢ়তা অব্যাহত রাখতে হবে এবং একের অন্যকে সমর্থন ও সহযোগিতা করতে হবে। এর মাধ্যমে অপরের কাছ থেকেও সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

এমতাবস্থায় মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে অন্যরা তাদের সহায়তা করার জন্য রয়েছে এবং ভবিষ্যতে তাদের জায়গায় আরও ভালো জায়গায় হবে। তাই মানুষ যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেদের সঠিক ভাবে চালিত করতে সক্ষম হয় ও পরিস্থিতি বিচারে নেতৃত্ব দিতেও সক্ষম হয়।

যদি আপনিও নেতৃত্ব দিতে চান তবে আপনাকে হতে হবে দৃঢ় এবং নমনীয়। আপনি যদি বিপ্লব ঘটাতে চান তবে আপনার অধীনস্তদের উন্নত ভবিষ্যতের আশ্বাস দিন,যদি সেই আশ্বাস নিভে যায় তবে আপনার লোকেরা আপনার পক্ষে লড়াই করা বন্ধ করবে।

সুতরাং জীবনে কখনো হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়া যাবেনা,আশাহত হয়া যাবেনা। আশা রাখতে হবে জীবনে সাফল্য ও সমৃদ্ধি আসবেই।

নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে পরিস্থিতির বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

মনে রাখতে হবে রাত যতো গভীর হয় ভোর তত নিকটে।

তো আজকে এই পর্যন্তই, বিজ্ঞান,প্রযুক্তি,মনোবিজ্ঞান,মনস্তত্ব সংক্রান্ত আপডেটের জন্য ডেইলি বঙ্গ নিউজ ২৪ ডট কম এর সাথে থাকুন।

আল্লাহ হাফেজ।

-ধন্যবাদ