কথায় বলে মানুষ অভ্যাসের দাস। তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু কেউ যদি বদভ্যাসের দাসে পরিণত হয়, তাহলেই বাধে বিপত্তি। চাইলেই বিটকেলে বদভ্যাসগুলোকে তাড়ানো যায়। সেগুলোকে নিজের দাসে পরিণত করা যায়।
সেদিন এক রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছিলাম। এক টেবিলে কয়েকজন বসেছেন। হঠাৎ একজন দিলেন বিষম হাঁচি। আশপাশে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর থকথকে সর্দি। যাঁরা খাচ্ছিলেন, সবাই অস্বস্তিতে পড়লেন। কিন্তু যিনি হাঁচি দিলেন, তিনি নির্বিকার। নাক মুছে আবার খাওয়া শুরু করলেন। হাঁচি যখন-তখন আসতেই পারে। নাকে টিস্যু বা রুমাল চেপে ধরে হাঁচি দিলেই ব্যাপারটি শোভন হয়। আশপাশেও জীবাণু ছাড়ায় না। আলাদাভাবে বিষয়টি ওই ব্যক্তিকে বুঝিয়ে বলতেই তিনি কিছুটা লজ্জা পেলেন। বললেন, ‘আমি তো এটা জানতামই না।’ এরপর তিনি ‘দুঃখিতও’ বললেন।
অনেকে জনসমক্ষে বিকট ভঙ্গিতে কান চুলকান। চুলকানোর জিনিসটি ময়লাসহ ফেলে রাখেন এখানে-সেখানে। সদ্য ভাত খেয়ে উঠে সে দৃশ্য দেখলে বমিও আসতে পারে। কেউ আবার আরাম করে নাকের ময়লা বের করতে থাকেন। অবলীলায় সেই ময়লা মুছে ফেলেন টেবিল, চেয়ার বা সোফায়। এমনকি অফিসের মিটিংয়েও নিজের অজান্তে এমন আচরণ করেন। আর তা দেখে অন্যদের পিলে চমকায়।
অনেকেই জোরে শব্দ করে হাঁটেন। কেউ কেউ হাঁটার সময় মেঝেতে পা ঘষে শব্দ করেন। ধপ করে চেয়ার টানেন। গ্লাস, বাটি রাখেন জোরে শব্দ করে। দরজা জোরে বন্ধ করেন বা খোলেন।
আসলে এগুলো সবই বদভ্যাস। এসব অভ্যাস অন্যের অসুবিধা ঘটায়। শিক্ষিত সমাজে এসবের কারণে অনেকে আপনাকে বলতে পারে ‘অভদ্র’ বা ‘আনকালচারড’। বেশি রেগে গেলে মনে মনে বলতে পারে ‘ছোটলোক’। স্ত্রী বা স্বামীর বদভ্যাসের কারণে দাম্পত্য কলহও বাড়ে।
খাওয়ারও কিছু অভ্যাস আছে। খাওয়ার সময় অনেকেই চপচপ শব্দ করে খান; যা অস্বস্তিকর। চা খাওয়ার সময় সড়ুত সড়ুত শব্দ করেন অনেকে।
ঘর ছেড়ে যাওয়ার সময় লাইট বা ফ্যান বন্ধ করার ব্যাপারটি বেমালুম ভুলে যান অনেকে। কেউ আছেন, যতক্ষণ ব্রাশ করেন, পানির কল ছেড়ে রাখেন। রাস্তায় কাউকে একটু আগে যেতে দিতে চান না। কোথাও লাইন মেনে চলতে চান না। একজন আরেকজনকে টপকে কীভাবে এগিয়ে যাবেন, সেটিই যেন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
কারও বাড়িতে গেলে জুতা খুলে ভেতরে ঢোকার কথা ভুলে যান অনেকে। আবার অনেকে বাথরুম ব্যবহার করে দরজা বন্ধ করতে ভুলে যান। অন্যের জিনিস ব্যবহারের পর সেটি সময়মতো ফেরত না দেওয়া বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না রাখাও বদভ্যাস।
কাউকে ফোন করে পাচ্ছেন না। অধৈর্য হয়ে পরপর ফোন দিতেই থাকলেন। অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি কোনো কাজে ব্যস্ত থাকতে পারেন। ফোন ধরার মতো পরিস্থিতি না-ও থাকতে পারে, সেটা বোঝেন না। এটিও বদভ্যাস। আবার উল্টো দিকও আছে। কারও ফোন ধরতে না পারলে পরে তাঁকে ফোন করা উচিত।
অনেকে আছেন, বাসে ওঠার পর ‘কন্ডাক্টর’ ভাড়া চাইলে বলেন, পরে আসেন। অথচ তিনি চাইলে ভাড়াটি মিটিয়ে দিতে পারেন। অনেক ‘সাধুপুরুষ’ আবার ভাড়া না মিটিয়েই সটকে পড়েন।
কেন এমন বদভ্যাস বজায় রাখে মানুষ? জানতে চাই কয়েকজনের কাছে। দেখা গেল, কেউ অজান্তেই এসব অভ্যাস চালিয়ে যান। কেউ আবার মনে করেন, তিনি যা করছেন, সেটাই ঠিক। কেউ স্রেফ অভ্যাসবশে করে যান এসব। অনেকে এ নিয়ে কথাই বলতে চান না।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আশরাফুল হক (ছদ্মনাম)। কারও বাসায় গেলে বাথরুম ব্যবহারের পর তিনি দরজা বন্ধ করেন। কিন্তু বাসায় যতবারই বাথরুমে যান, দরজা খুলে রাখেন। বাথরুমের সামনেই তাঁদের খাবার ঘর। এ নিয়ে প্রায়ই সংসারে শুরু হয় খুটখাট। কেন এমন করেন, জানতে চাইলে বলেন, বাসায় আবার এত নিয়ম কিসের? তিনি মনে করেন, এসব বদভ্যাস বাসায় চালিয়ে যাওয়া যায়। বোঝালেও মানতে চান না। আবার বাসায় তিনি লাইট, ফ্যান বন্ধ করেন বিলের ভয়ে। কিন্তু অফিসে করেন না। কারণ, অফিসের বিল তো আর তাঁকে দিতে হয় না।
যখন-তখন নাকে হাত দেওয়া অভ্যাস ১৭-১৮ বছরের আরিফের (ছদ্মনাম)। ঢাকার নামীদামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে সে। অনেক বকাঝকা দিয়েও এই অভ্যাস ছাড়ানো যাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলে জানাল, নাক চুলকে সে একধরনের আরাম পায়। কে কী ভাবল, তার চেয়ে এই আরামটাই তার কাছে বেশি প্রিয়।
ছোটবেলা থেকে ভালো অভ্যাস নিয়ে বড় হয়েছিলেন আসমা (সংক্ষেপিত নাম)। বিয়ের পর দেখলেন, স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির সবাই কোনো না কোনো বদভ্যাসে আক্রান্ত। কেউ ব্যবহারের পর বাথরুম অপরিষ্কার রাখেন, কেউ ফ্রিজের দরজা ট্রাকের দরজার মতো সশব্দে বন্ধ করেন। বাড়িতে উচ্চ শব্দে টিভি চালান। অনেক বলে, বুঝিয়েও পাল্টাতে পারেননি কাউকে। উল্টো অশান্তি বেড়েছে। এই পরিবেশে থেকে আসমা নিজেও এখন এসব বদভ্যাসে আক্রান্ত।
হয়তো ভাবছেন, আপনি অনেকের অপছন্দের তালিকায় কেন? অথবা বাড়িতে আপনার ওপর লোকজন বিরক্ত কেন? ভেবে দেখুন, আপনার এসব আচরণ তাঁদের বিরক্তির কারণ নয় তো? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে যে একটু সচেতন হতে হয়।
শিশুর ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে পারে পরিবার। স্কুলগুলোতেও এসব শিক্ষা দেওয়া জরুরি। ক্লাস ছেড়ে যাওয়ার সময় শিশুদের ফ্যান বন্ধ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন শিক্ষকেরা। মিশনারি স্কুলগুলো এসব ব্যাপারে কিছুটা এগিয়ে। পরিবার থেকে না পেলেও নিজে একটু সচেতন হলে চারপাশের মানুষকে দেখলেও এই শিক্ষা পাওয়া কঠিন নয়। সবার আগে ইচ্ছাটা দরকার।
এসব বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সমাজতাত্ত্বিক মাহবুবা নাসরিনের সঙ্গে। জানালেন, একেক পরিবার একেক রকম। তাই সু-অভ্যাসের শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষায় এ বিষয়ে আলাদা কারিকুলাম থাকতে পারে। বন্ধু বা কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীরা মিলে আলোচনার মাধ্যমে চর্চা করতে পারে সু-অভ্যাসের। বেসরকারি সংস্থা ও গণমাধ্যমও এ ব্যাপারে প্রচার চালাতে পারে। মায়েদের মধ্যে এই শিক্ষাদান বেশি জরুরি। তাহলে তিনি সন্তানকে এসব শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক কামাল চৌধুরী বলেন, ‘যেসব অভ্যাস প্রকাশ্যে করলে মানুষ অপছন্দ করে বা স্বাভাবিকভাবে নেয় না, সেটাই বদভ্যাস। ধীরে ধীরে এই অভ্যাস তৈরি হয়। হয়তো কেউ মা-বাবাকে দেখেছে প্রকাশ্যে নাকে হাত দিতে, সেটাই তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়েছে। ফলে সে-ও প্রকাশ্যে নাকে হাত দেওয়াতেই অভ্যস্ত। যেভাবে এ অভ্যাস আমরা তৈরি করি, সেভাবেই এটা ঝেড়ে ফেলা যায়। তবে কেউ যদি মনে করে, এসব অভ্যাসই ঠিক, কে কী ভাবছে তাতে কিছু যায়-আসে না, তাহলে নিজেকে বদলানো যাবে না। ছাড়তে চাইলে নিজেকে ভাবতে হবে, কখন, কোন পরিস্থিতিতে এ অভ্যাসগুলো হয়ে যাচ্ছে। সেগুলো থেকে সরে আসার চেষ্টা করতে হবে।’
বদভ্যাস ছাড়ার ক্ষেত্রে নিজেই নিজের শিক্ষক হওয়া যায়—বললেন মনোবিদ মেখলা সরকারও। তিনি বলেন, ‘প্রথমে শপথ নিতে হবে, আমি এ কাজ করব না। লিখে রাখা যেতে পারে। বারবার সেগুলো পড়ে নিজেকে শোধরাতে হবে। পরিবার বা বন্ধু কারও মধ্যে এ রকম বদভ্যাস থাকলে তাঁর মনে আঘাত দেওয়া যাবে না। সবার সামনে না বলে আলাদাভাবে বিষয়টি তাঁকে বুঝিয়ে বলাটা জরুরি। এমনভাবে বলা যাবে না, যাতে তিনি অপমান বোধ করেন।’