বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সিলেট জেলা শাখার কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে।সিলেটে ছাত্রলীগকর্মী ওমর মিয়াদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সংগঠনটির বিভিন্ন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বুধবার রাতে এ তথ্য জানানো হয়।
এর আগে সোমবার বিকালে সিলেট নগরীর টিলাগড় এলাকায় ছাত্রলীগকর্মী ওমর মিয়াদ (২২) ছুরিকা হামলায় মারা যান।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের এক জরুরি বৈঠকের সিদ্ধান্তমতে সিলেট জেলা শাখার কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হল।
একই সঙ্গে নতুন কমিটির জন্য বিভিন্ন পদে জীবনবৃত্তান্ত চাওয়া হয়েছে। আগামী ২৫ অক্টোবরের মধ্যে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে এই জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে হবে।
বুধবার রাতে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রায়হান চৌধুরী, ছাত্রলীগকর্মী তোফায়েল আহমদ ও তার ভাই ফখরুল ইসলামসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করার পাশাপাশি অজ্ঞাত আরও পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন নিহত মিয়াদের বাবা আখলু মিয়া।
হত্যাকাণ্ডের এ ঘটনায় ছাত্রলীগকর্মী তোফায়েল ও তার ভাই ফখরুল ইসলামকে ইতোমধ্যেই আটক করেছে পুলিশ।
বদনাম কুড়াচ্ছে সিলেট ছাত্রলীগ
একের পর এক বিতর্কিত কা- ঘটিয়ে বদনাম কুড়াচ্ছে সিলেট ছাত্রলীগ। জাতীয় শোক দিবসে নগরীর রিকাবীবাজারে এক রেস্টুরেন্টে ঝগড়া-বিবাদের সময় পুলিশ সদস্যকে মারধরের পর বুধবার রতে এক ব্যবসায়ী ছাত্রলীগ কর্মীদের মারধরের শিকার হন।
বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর হযরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহ গেট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহত ব্যবসায়ীকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
জানা গেছে, বুধবার রাতে দরগা গেট এলাকার হলি স্পট নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যান ছাত্রলীগ কর্মী রনি ও তার এক সহযোগী। এ সময় দোকানের ভেতর তারা উচ্চৈস্বরে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। দোকানের মালিক পাপলু তাদের আস্তে কথা বলতে অনুরোধ করেন।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ওই দুই ছাত্রলীগ কর্মী। দোকান থেকে বের হয়ে তারা মোবাইল ফোনে তাদের সহকর্মীদের খবর দেয়। কিছুক্ষণ পর মোটরসাইকেলে ৮-১০ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী এসে ব্যবসায়ী পাপলুর ওপর হামলা চালায়।
তারা বেধড়ক মারধর করে তাকে গুরুতর আহত করে। পরে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রেরণ করেন। ছাত্রলীগ কর্মী রনির নেতৃত্বে এই হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে।
জাতীয় শোক দিবসের দিন নগরীর রিকাবীবাজারে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পর ম্যানেজারের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হয়। এ বিষয়ে কথা বলতে যাওয়া পুলিশ সদস্যকে বেধড়ক মারধর করে সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক দফতর সম্পাদক তানভীর কবীর সুমন ও তার সহযোগীরা।
জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচী পালন নিয়ে এমসি কলেজ ছাত্রলীগের বিবদমান গ্রুপগুলো টিলাগড় এলাকায় মহড়া দেয়। এ নিয়ে এলাকায় ভীত-সন্তস্ত্র পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এমসি কলেজ এলাকায় বিপুল পরিমাণ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করে শাহপরাণ থানা।
গত সপ্তাহে একাধিকবার ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় এমসি কলেজ হোস্টেলের কয়েকটি কক্ষ ভাংচুর হয়। সম্প্রতি সিলেটে ছাত্রলীগ কর্মীদের বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকা- নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বিভিন্ন সিন্ধান্তও গ্রহণ করেছে। তা সত্ত্বেও চলমান কর্মকা- দলের ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করছে।
যেমন চলছে সিলেট ছাত্রলীগ
সিলেটে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। নেতাকর্মীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত হয়ে পড়েছেন কিছু নেতাকর্মী। ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মহড়া, পুলিশের ওপর হামলা, সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় উত্তাপ ছড়াচ্ছে নগরীতে। এতে করে দেখা দিয়েছে আতঙ্কও। সর্বশেষ গত সোমবার রাতে নগরীর টিলাগড়ে চোরাগোপ্তা হামলা হয়েছে। এ হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতা।
এর আগে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে সশস্ত্র মহড়া দিয়েছে ছাত্রলীগ। আর পুলিশের ওপর হামলা চালাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন ছাত্রলীগের ১১ নেতাকর্মী। এরমধ্যে ৫ জন ছাত্রলীগের কমিটিতেও আছেন।
হঠাৎ করে ছাত্রলীগের এই কর্মকাণ্ডের ঘটনায় সিনিয়র নেতারা বিব্রত। এর কারণ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণেই গেল কয়েক মাস ধরে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত ছিল।
এর মধ্যে ডিসেম্বরের শেষদিকে যখন ছাত্রলীগের কমিটির ওপর থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয় তখন থেকে গোটা জেলায়ই কমিটি সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল।
কিন্তু বিতর্কিত কর্মকাণ্ড কমিটি গঠনের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নেতারা। রোববার ভোররাতে ছাত্রলীগের কর্মীরা নগরীর কুমারপাড়া এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা চালায়।
এ ঘটনায় পুলিশ ঝরনারপাড় এলাকার মৃত যতিলাল দাসের ছেলে ইমন দাস (২৫), কালিবাড়ী এলাকার (মূলবাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া থানার সয়রাবাড়ী) আবদুল হাকিমের ছেলে মনিরুল ইসলাম (২৪), কালিবাড়ী এলাকার মৃত আবদুস সালামের ছেলে কামরুল ইসলাম (২৬), একই এলাকার সূফি মিয়ার ছেলে সুজেল আহমদ তালুকদার (৩৩), সজীব আহমদ তালুকদার (২১) ও সৌরভ তালুকদার (১৯), চৌকিদেখি এলাকার সমশের মিয়ার ছেলে সাহেদ আহমদ (২৮), কালিবাড়ী ভাটপাড়া এলাকার মৃত কবির উদ্দিন খানের ছেলে জুবায়ের খান (৩০), চৌকিদেখী এলাকার ইয়াকুব আলীর ছেলে মাসুদ আহমদ (২৩), মজুমদারী এলাকার আবদুল ওহাবের ছেলে শামসুজ্জামান (২৬) ও কালিবাড়ী সবুজ বাগিচা এলাকার অনিল চন্দ্র পালের ছেলে সুমন পাল (৩২)কে গ্রেপ্তার করে।
পরবর্তীকালে তাদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
মামলার এজাহারে এসআই হাবিবুর রহমান উল্লেখ করেছেন, রাত ৩টা ৪০ মিনিটে ঝরনারপাড় এলাকায় প্রবেশমুখে চেকপোস্টে ডিউটি করছিলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। এসময় একটি প্রাইভেটকার (ঢাকা মেট্রো-গ-১৪-৮৬৪০) আসতে দেখে সেটিকে থামানো হয়।
গাড়িতে থাকা ৪ ব্যক্তির আচরণ ‘সন্দেহজনক’ হওয়ায় এক্স-করোলা মডেলের গাড়িটি তল্লাশি করা হয়। এসময় পেছনের সিটে বসা ইমন দাস ও তানভীরের মাঝ থেকে সাদা রঙয়ের একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে ৪৩ বোতল ফেনসিডিল পাওয়া যায়।
এ ঘটনায় ফেনসিডিল ও প্রাইভেটকারসহ জব্দ তালিকা তৈরি করে সোবহানীঘাট পুলিশ ফাঁড়িতে জিডি দায়ের করে (নং-৪৯৯) পুলিশ। পরে প্রাইভেটকারে থাকা ৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় একজন তাদের পূর্বপরিচিত কয়েকজনকে ফোন দেয়।
৬-৭টি মোটরসাইকেলে করে কয়েকজন দেশে তৈরি অস্ত্র নিয়ে রাত ৩টা ৫০ মিনিটে ঘটনাস্থলে এসে পুলিশের ওপর হামলা করে। তারা ইটপাটকেলও নিক্ষেপ করে।
এভাবে সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রলীগের মহড়া আলোচিত হয়েছে। গত ৬ মাস ধরে এমসি কলেজের ক্যাম্পাস ছিল শান্ত। সোমবার সকাল ১০টার দিকে কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক বদরুল আজাদ রানা ও সদস্য সচিব দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে সরকারি কলেজের হোস্টেলের সামনে থেকে মিছিল বের করা হয়।
ছাত্রদল কর্মীরা মিছিল নিয়ে ফটকের সামনে আসামাত্র এমসি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন ও হুসেইন আহমদের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ কর্মীরা তাদের বাধা প্রদান করে। এ সময় শুরু হয় উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। একপর্যায়ে পুলিশ এগিয়ে এলে ছাত্রদল কর্মীরা ব্যানার রেখেই পালিয়ে যায়।
এ সময় ছাত্রলীগের কর্মীরা হাতে রামদা, দা ও লাঠিসোটা নিয়ে মহড়া দেয়। তারা টিলাগড় পয়েন্ট পর্যন্ত ছাত্রদলকে ধাওয়া করে। পরে পুলিশ অবশ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এদিকে ছাত্রদল কর্মীরা ধাওয়া খেয়ে চলে যাওয়ার পর এমসি কলেজের ফটকেই তাদের ব্যানারে আগুন ধরিয়ে দেয় ছাত্রলীগের কর্মীরা।
সিলেট নগরীর টিলাগড়ে মুখোশধারীদের চোরাগোপ্তা হামলায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রাজন চৌধুরী আহত হয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার ভোররাতে এ ঘটনা ঘটে। গ্রুপিং- কোন্দলের জের ধরে এ ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের ক্যাডাররা মিলে এ হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছেন আহত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রাজন চৌধুরীর ভাই সাজন চৌধুরী।
এ ঘটনায় আহত অন্য দুজনকে বর্তমানে সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আলী হোসেন নগরীর সোবহানীঘাট এলাকায় নিজ দখলে রেখেছিলেন এক প্রবাসীর বাসা। পরবর্তীকালে ওই প্রবাসী সিলেটের কোতোয়ালি ও শাহপরান থানায় দুটি মামলা করেছিলেন। ওই মামলার প্রেক্ষিতে পরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
এ ঘটনা কেন্দ্রীয় কমিটির নজরে আসার পর আলী হোসেনকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ মানবজমিনকে জানিয়েছেন, সিলেটে ছাত্রলীগ পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করে। কিন্তু ছাত্রলীগ নামধারীরা দলের ভেতরে ঢুকে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করছে। যারা বহিরাগত রয়েছে তাদের চিহ্নিত করা হবে। এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার কথা বার্তা হচ্ছে বলে জানান। অচিরেই ছাত্রলীগ বহিরাগতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থায় যাবে। তিনি বলেন, বহিরাগতদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করা হয়েছিল।
এরপর যখন স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের পর সিলেটে ছাত্রলীগকে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করা হয় তখন একটি মহল পরিকল্পিতভাবে বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। এজন্য সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের সতর্ক থাকার আহবান জানান তিনি।