জেলহত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ালেও তাদের দেশে ফেরত আনা যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আসামিরা যেসব দেশে আছে, সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ আইনের কারণে ফিরিয়ে আনতে দেরি হচ্ছে। তবে ওইসব দেশের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।
২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল জেলহত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। দীর্ঘদিন পরও সাজাপ্রাপ্তদের সাজা নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। এ নিয়ে নিহত চার নেতার স্বজনদের রয়েছে হতাশা। মামলার ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনকে সাজা দেওয়া হয় ও পাঁচজনকে খালাস দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত তিন জন হলো—রিসালদার মোসলেহ উদ্দীন, মারফত আলী শাহ ও আবুল হাসেম মৃধা। মামলার মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত তিন জনই বর্তমানে পলাতক।
আর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১২ জন হলো, আহমেদ শরফুল হোসেন, হাশেম কিসমত, নাজমূল হোসেন আনসার, খন্দকার আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী, আবদুল মাজেদ, ফারুক, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ফারুক, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিনের বঙ্গবন্ধু হত্যামামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
বাকি আটজনের মধ্যে আব্দুল মাজেদ ও হাশেম কিসমতের মৃত্যুর খবর শোনা গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি।
দণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সেনেগাল ও জিম্বাবুয়েতে রয়েছে বলে একাধিকবার সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। তাদের দেশে ফিরে আনতে সরকার সার্বক্ষণিক ওই রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘দণ্ডাদেশপ্রাপ্তদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের উদ্যোগ আমাদের রয়েছে। আমরা মনে করি, আমরা যতই সফলতা থাকুক না কেন, আমাদের কাজ অসমাপ্ত থেকে যাবে, যত দিন না পর্যন্ত আমরা জাতির জনক বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের ফিরিয়ে আনতে পারব।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘খুনিরা যে যে দেশে আছে, সেই দেশের অভ্যন্তরীণ আইনের প্রক্রিয়াগত বিষয় একটি বাধা। আবার এ রকমও আছে, যেখানে আইন কোনও বাধা নয়, তারপরও দণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা একটি অস্থায়ী সেফটি নেট নিয়ে রয়েছে। আশা করি, তাদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে পারব।’
চূড়ান্ত রায় হওয়ার পরও দণ্ডাদেশপ্রাপ্তদের দণ্ড কার্যকর না হওয়ায় নিহত চার নেতার স্বজনদের মনে হতাশা থাকলেও তারা এই সরকারের ওপর আস্থা রাখার কথা জানিয়েছেন। নিহত মোহম্মদ কামারুজ্জামানের ছেলে খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘রায় যদি কার্যকর না হয়, তাহলে বিচারের সে রায়টি রায়ই থেকে গেল। সেটি আর বাস্তবায়িত হলো না। সুতরাং আমরা অন্যান্য পরিবারের মতো তাকিয়ে আছি। আসলে নানা কারণে হয়তো রায়টি কার্যকর যাচ্ছে না। কেউ বিদেশি আশ্রয় আছে, কেউ পলাতক অবস্থায় আছে।’ তিনি বলেন, ‘কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। আমাদের সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মিশন কাজ করছে। আমরা আশাবাদী, তাদের ট্রেস পাওয়া যাবে। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এই বিষয়টি যত দ্রুত হবে, দণ্ডও তত দ্রুত কার্যকর করা হবে।’
ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার না হওয়ার বিষয়ে খায়রুজ্জমানা লিটন বলেন, ‘২০০৪ সালের রায়কে আমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। সেটি ছিল প্রহসনের রায়। ওই রায়ে ষড়যন্ত্রকারীদের খালাস দেওয়া হয়েছে। আমরা আদালতের ওপর শ্রদ্ধাশীল। আইনগতভাবে যা করার এ বিষয়ে করা হয়েছিল। আমরা এখন রায় কর্যকরের অপেক্ষায় আছি।’
জাতীয় চার নেতার একজন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে যেসব সেনা সদস্য হত্যা করেছিল, অক্টোবর মাসের শেষের দিকে তারা জাতীয় চার নেতাকে বন্দি করে রাখা কারাগারের সেলগুলো রেকি করতে শুরু করে। জেলখানায় যা ঘটছে সেই ইতিহাস ভিন্ন হতে পারতো, যদি কারা কর্তৃপক্ষ সাহসী কোনও পদক্ষেপ নিতো।’ তিনি বলেন, ‘রায় কার্যকরের জন্য সব পরিবারের মতো আমরাও রায় কার্যকরের জন্য অপেক্ষায় আছি।’
খুনিরা কে কোথায়?
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয়, তার অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে। ওই ঘটনায় মামলা দায়েরের ২৩ বছর পর ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান মামলার রায় দেন। ২০০৮ সালে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের রায় হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন (লিভ টু আপিল) করা হয়। ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন মঞ্জুর করেন। ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল আপিলের রায়ে ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনের সাজা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর খুনিদের বাংলাদেশে থেকে থাইল্যান্ডের একটি প্লেনে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে অনেক খুনিকে চাকরি দেওয়া হয় বিভিন্ন দূতাবাসে। মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর থেকে তারা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
রাশেদ চৌধুরী
রাশেদ চৌধুরী ১৯৬৯ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। ১৯৭৬ সালে জেদ্দায় কূটনীতিক পদে যোগ দেয়। সে নাইরোবি, টোকিও, কুয়ালালামপুর ও ব্রাসিলিয়াতে বাংলাদেশ মিশনে কাজ করেছে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সময়ে সে ব্রাসিলিয়ায় কর্মরত ছিল। একই বছরের জুলাই মাসে তাকে ঢাকায় ফেরত আসার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই সময় ব্রাসিলিয়ায় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ইফতেখারুল করিম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়ে জানান, রাশেদ চৌধুরী সাও পাউলো থেকে সান ফ্রানসিসকো চলে গেছে। ওই সময় থেকে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে।
নূর চৌধুরী
নূর চৌধুরী ১৯৭৬ সালে ব্রাসিলিয়ায় বাংলাদেশ মিশনে তার কূটনীতিক জীবন শুরু করে। আলজিরিয়া ও হংকংয়ে বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিল। ১৯৯৬ সালে তাকে দেশে ফেরত আসার নির্দেশ দেওয়া হলে সে কানাডায় পালিয়ে যায়।
২০০৪ সালে কানাডার অভিবাসন কোর্ট তার রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করেন এবং তখন কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাংলাদেশের দূতাবাসের কাছে হস্তান্তর করার সময়ে তাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে তাদের আগ্রহের কথা জানায়। ওই সময়ের বাংলাদেশ সরকারের অনাগ্রহের কারণে তাকে ফেরত আনার কাজটি করা সম্ভব হয়নি।
এরপরে ২০০৭ সালে কানাডার সর্বোচ্চ আদালত রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা নাকচ করে দেওয়ার পরে নূর চৌধুরী প্রি-রিস্ক রিমুভাল এসেসমেন্ট বিধির আওতায় কানাডার অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে আবেদন করে। ওই আবেদন এখন পর্যন্ত মীমাংসা হয়নি। এ সুযোগ নিয়ে কোনও স্ট্যাটাস ছাড়াই নূর চৌধুরী কানাডায় রয়েছে।
শরীফুল হক ডালিম
শরীফুল হক ডালিম প্রথম কূটনীতিক হিসেবে কাজ শুরু করে ১৯৭৬ সালে বেইজিংয়ে। ১৯৮২ সালে তাকে হংকংয়ে বদলি করা হয় এবং ১৯৮৮ সালে কেনিয়ায় রাষ্ট্রদূত হিসাবে পদায়ন করা হয়। ১৯৯৫ সালে বিএনপি সরকার তাকে ফোর্স রিটায়ারমেন্টে পাঠায়।
ধারণা করা হয় ডালিমের কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে ব্যবসা আছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত খবরের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে গত বছরের শেষ দিকে পাকিস্তান সরকারকে একটি নোট ভারবাল পাঠিয়ে জানতে চায়, ডালিম পাকিস্তানে কোথায় আছে?
গত মার্চ মাসে তাকে স্পেনে দেখা গেছে বলে খবর পাওয়ার পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের থেকে স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা বাংলাদেশের কাছে এ বিষয়ে আরও তথ্য জানতে চেয়েছে।
রিসালদার মোসলেহউদ্দিন আহমেদ
দীর্ঘদিন ধরে পলাতক থাকার পরে সরকার গত বছর জানতে পারে মোসলেহউদ্দিন আহমেদ জার্মানিতে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বছরের জানুয়ারিতে জার্মান সরকারকে একটি নোট ভারবাল পাঠানো হয়। জার্মান সরকার এ বিষয়ে আরো তথ্য জানতে চেয়েছে এবং জার্মানিতে বাংলাদেশ দূতাবাস এ বিষয়ে যোগাযোগ রাখছে।
খন্দকার আব্দুর রশীদ
খন্দকার আব্দুর রশীদকে পাকিস্তানে দেখা গেছে, এমন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে পাকিস্তান সরকারকে একটি নোট ভারবাল দেওয়া হয় গত ডিসেম্বরে। কিন্তু এ বিষযে এখনও পাকিস্তান সমরকার কোনও উত্তর দেয়ানি।
আব্দুল মাজেদ
আব্দুল মাজেদ কোথায় রয়েছে, সে বিষয়ে সরকারের কাছে কোনও তথ্য নেই।