ফেসবুক কি আর মানুষকে সেভাবে টানতে পারছে? ফেসবুক দিন দিন আকর্ষণহীন হয়ে পড়ছে। গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ফেসবুকে সক্রিয়তা অনেক কমে গেছে। এখন সেখানে শুধু ব্র্যান্ড আর চটকদার খবর। বন্ধু-পরিবারের মধ্যে যোগাযোগের যে আকর্ষণ, তা আর নেই।
ফেসবুক অবশ্য সম্প্রতি ২০০ কোটি ব্যবহারকারীর মাইলফলক ছোঁয়ার কথা বলেছে। অবশ্য মোটে গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠান গর্ব করে তাঁদের ১০০ কোটি গ্রাহকের কথা বলতে পারবে। কত ভোগ্যপণ্য ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ২০০ কোটি গ্রাহক হতে পারে? সে ক্ষেত্রে ফেসবুক অনেকটাই এগিয়ে। কোনো প্রতিষ্ঠানই ফেসবুকের মতো এত দ্রুত ব্যবহারকারী বাড়াতে পারেনি।
সম্প্রতি ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ প্রতিষ্ঠানটির ২০০ কোটি ব্যবহারকারীর মাইলফলক ছোঁয়ার ঘোষণা দেন। প্রতি মাসে ২০০ কোটি ব্যবহারকারী ফেসবুকে লগইন করছেন। অবশ্য ফেসবুক কখনো ব্যবহারকারীদের ‘কাস্টমার’ বা গ্রাহক বলে না। এর পরিবর্তে জাকারবার্গ ‘কমিউনিটি’ বা সম্প্রদায় শব্দটি ব্যবহার করেন।
প্রথম ১০০ কোটির মাইলফলক পেরোতে ফেসবুকের আট বছর সময় লেগেছিল। পরের ১০০ কোটিতে পৌঁছাতে সময় লেগেছে মাত্র পাঁচ বছর। প্রতি সপ্তাহে ৫০ লাখের বেশি ব্যবহারকারী বাড়ছে। ফেসবুকের এই অর্জন অসাধারণ। বিশ্লেষকদের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বে ৩৫০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আছেন। এর মধ্যে ৭৫ কোটি মানুষ চীনের। সেখানে ফেসবুক নিষিদ্ধ। অর্থাৎ, এখন মাত্র ৮০ কোটি মানুষের ইন্টারনেট আছে, যাঁদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ফেসবুকের দৌড়ের শেষ আছে। কারণ, ইন্টারনেট সংযোগ বাড়ছে ধীরে। জাকারবার্গ তাই নির্ভার থাকতে পারছেন না। ফেসবুক ব্যবহারকারী বাড়ার হার বেশি আর ইন্টারনেট বাড়ার হার কম। নানা প্রচেষ্টায় ইন্টারনেট সংযোগ বাড়ানো ও ফেসবুক ব্যবহারকারী বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। অনেক সাশ্রয়ী দামের স্মার্টফোন ও দুর্বল ইন্টারনেটে চলার উপযোগী করে ফেসবুক সংস্করণ তৈরি করছেন। বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের সঙ্গে চুক্তি করে ডেটা খরচ কমানোর চেষ্টা করছে। এ ছাড়া নিজস্ব অবকাঠামো তৈরিতে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ড্রোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট সুবিধা দিতে অ্যাকুইলা নামের সৌরশক্তিচালিত ড্রোন নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ফেসবুকের সব প্রচেষ্টা অবশ্য সাফল্যের মুখ দেখেনি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ফেসবুকের বিনা মূল্যে ইন্টারনেট দেওয়ার প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়েছে। টেলিকম অপারেটররা তাঁদের বিনিয়োগ করা অবকাঠামোতে বিনা খরচার ব্যবসা করার সুযোগ দিতে অনীহা দেখাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও ফেসবুকের ওপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে। এতে ফেসবুকের ব্যবহারকারী বৃদ্ধির হার কিছুটা কমে আসছে।
২০০ কোটি ব্যবহারকারীর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ব্যবহারকারী প্রতিদিন ফেসবুকে ঢোকেন। এ থেকে বোঝা যায়, ফেসবুক কতটা আকর্ষণ ধরে রাখতে পারছে। গত দুই বছরে এই হার একই জায়গায় আছে। এতে বোঝা যায়, ফেসবুক ব্যবহারকারী বাড়লেও সক্রিয়তার হার খুব বেশি বাড়ছে না। এ ছাড়া গত কয়েক বছর ধরে ফেসবুকের জন্য আরেকটি আশঙ্কাজনক বিষয় হচ্ছে—ফেসবুকে পোস্ট কমে যাওয়া। ফেসবুকে লগইন করলেও পোস্টের সংখ্যা কমতে দেখা যাচ্ছে। অনেকেই অভিযোগ করছেন, ফেসবুক এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ড আর ভাইরাল কনটেন্টে ভরে গেছে।
ফেসবুকের বড় আরেকটি ধাক্কা হচ্ছে এর ‘স্টোরিজ’ ফিচারটি। এ ফিচারটি স্ন্যাপচ্যাটের কাছ থেকে সরাসরি নকল করে গত মার্চ মাসে ফেসবুকে বসানো হয়। এতে ২৪ ঘণ্টার পর ছবি ও ভিডিও অদৃশ্য হয়ে যায়। এটা চালুর পর থেকে অনেকেই তা ছুঁয়ে দেখেননি।
ফেসবুক ব্যবহারকারীরা কতটা ফেসবুকে আগ্রহ দেখাচ্ছেন, সে বিষয়ে নিয়মিত তথ্য দিচ্ছে না ফেসবুক। গত বছরের এপ্রিল মাসে ফেসবুক বলেছিল, দিনে ৫০ মিনিট ফেসবুক. মেসেঞ্জার ও ইনস্টাগ্রামে সময় কাটান ব্যবহারকারীরা। এরপর থেকে আর কোনো তথ্য দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি।
তথ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইমার্কেটারের তথ্য অনুযায়ী, ফেসবুকের তিনটি আকর্ষণীয় সেবার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফেসবুক। এ বছর ফেসবুকে সময় কাটানোর হার কমে গেছে। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের কাছে অন্যান্য তথ্যও খুব বেশি দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। ফেসবুকে কতক্ষণ ভিডিও দেখা হচ্ছে বা এ ধরনের তথ্য না জানানোয় ধারণা করা যায়, ফেসবুকের আকর্ষণ কমছে।
অবশ্য ফেসবুকের বিপরীতে বেশ কিছু সফলতাও আছে প্রতিষ্ঠানটির। ১০০ কোটি মার্কিন ডলার দিয়ে কেনা ইনস্টাগ্রাম এখন দারুণভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এখান থেকে অনেক বেশি আয় আসতে শুরু করেছে। বিজ্ঞাপনদাতারা এখন ছুটছেন সেদিকেই।
ফেসবুক আকর্ষণ ধরে রাখতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তথ্যসূত্র: টেলিগ্রাফ।