স্বপ্ন নিয়ে মানুষের আগ্রহ সেই প্রাচীনকাল থেকে। প্রাচীনকালের লোকজনের নানা উপকথা,মিথ এ ছড়িয়ে আছে এই স্বপ্ন।অনেকে মনে করত, স্বপ্নে আত্মা দেহ ত্যাগ করে নাকি ঘুরতে বের হয়! আবার অনেকে ভাবেন,স্বপ্ন ভবিষ্যতের অনেক কিছুই নির্দেশ করে। আমাদের দাদী নানীদের ও তাই স্বপ্ন নিয়ে নানান ব্যাখ্যা দিতে দেখা যায়। খোয়াবনামা বইটি এখনো হয়ত আমাদের অনেকের ঘরেই পাওয়া যাবে।সেই স্বপ্নেরই এক অত্যাশ্চর্য বিষয় হচ্ছে লুসিড ড্রিমিং।
লুসিড ড্রিমিং কিঃ
আমরা সবাই স্বপ্ন দেখার সাথে অনেক ভালোভাবেই পরিচিত। কিন্তু মাঝে মাঝে আমরা বুঝতে পারি এটা স্বপ্ন কিন্তু এর অনুভূতি গুলো হয় অনেক বাস্তব। মনে হয় যে আপনি ওই স্বপ্নের জায়গাতেই আছেন এবং পরিবেশ পরিস্থিতি এমব ভাবে উপলব্ধি করতে পারেন যেন বাস্তবেই হচ্ছে।
সচেতন মনে অধ্যাবসায় এবং চেষ্টার দরুন কেউ যদি স্বপ্ন দেখা কালীন বুঝতে পারে যে সে স্বপ্ন দেখছে বা স্বপ্নের মধ্যে রয়েছে তবে সেই স্বপ্ন দেখাকে ইংরেজিতে বলা হয় লুসিড ড্রিমিং।
লুসিড ড্রিম” এর “লুসিড” শব্দটার অর্থ হলো “স্পষ্ট বা পরিস্কার” আর “ড্রিম” মানে “স্বপ্ন”।
সর্বপ্রথম মনে করা হয় যে এই ড্রিমিং অনুভূত করেন অ্যারিস্টোটল।
তিনি বলেন যে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকাকালীন কোন ব্যাক্তি এই সময় বুঝতে পারে যে সে ঘুমাচ্ছে এবং যে স্বপ্ন দেখছে সেই স্বপ্নের মধ্যে থাকা বিষয় বা বস্তু সম্পর্কে সে সচেতন এবং সেই বস্তু তার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারছে।
এটা সম্বন্ধে সঠিক জানা নেই যে এই বিশ্বের কজন মানুষ এই ড্রিমিং অনুভূত করেছে। তবে ব্রাজিলে একটা পরীক্ষা চালানো হয় প্রায় 2500 মানুষের উপর যার মধ্যে দেখা যায় প্রায় 70 শতাংশের বেশি মানুষ এই ড্রিমিং অনুভূত করেছে।
কেউ কেউ খুব সহজেই এই আধা ঘুম আধা জাগরন অবস্থায় থেকে এই বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে, আবার অনেকে আছে যারা অনেকদিনের ধৈর্য এবং প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেকে এই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তৈরি করে।
এখন কথা হচ্ছে, আপনি কখন লুসিড ড্রিম দেখবেন তা তো আর আগে থেকে বলা যায় না। তবে কায়দা করে আপনি লুসিড ড্রিম এর অভ্যাস তৈরি করে ফেলতে পারেন।
লুসিড ড্রিমিং এর কৌশলঃ
– যখন এই ড্রিমিং অনুভূত করতে চাইবেন তখন নিজের ঘরকে ঘুমানোর জন্য একটা যথোপযুক্ত পরিবেশ দিন।
একটা স্নিগ্ধ শান্ত ঘর আপনাকে ঘুমাতে সাহায্য করবে।
– একটা ডাইরি বা নোটপ্যাড রাখুন নিজের কাছে, ঘুম থেকে উঠে যে স্বপ্ন দেখলেন সেটা মনে করার চেষ্টা করে লিখে রাখুন।
– কখন ঘুম আসছে না সেই সময় কি কি অনুভূত হচ্ছে তা মনে রাখার চেষ্টা করুন।
– একটা ঘড়ি বা লেখা নিজের সামনে রাখুন। প্রতিদিন একই সময়ে সেই লাইন টা পড়ুন বা ঘড়ির সময় দেখার চেষ্টা করুন। যদি আপনি ঘুমিয়ে থাকেন তাহলে সময় বা লাইন পাল্টাতে থাকবে।
– ঘুমানোর সময় প্রতিদিন চেষ্টা করুন সচেতন মনে একই কথা বার বার বলার যতক্ষণ অব্দি ঘুম না আসে। এতে আপনার সচেতন মস্তিষ্কে সংকেত প্রেরিত হবে যে আপনি লুসিড ড্রিমিং করতে চান।
– একটি কৌশলের নাম হলো রিয়েলিটি চেক বা বাস্তবতার পরীক্ষা।দিনের যেকোনো সময় যখনই সম্ভব আপনার নিজের এবং পরিবেশের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করুন ‘আমি কি স্বপ্ন দেখছি?’ কাজটি যখন অভ্যাসে পরিণত হবে তখন এটি ঘটার সম্ভাবনা থাকবে স্বপ্নের মধ্যেও। স্বপ্নের মধ্যেই আমরা নিয়মিত এমন এমন জিনিস দেখি যেটা আসলে বাস্তবে সম্ভব নয়, যেমন সুপারম্যানের মতো ওড়াওড়ি বা অনেক লম্বা লম্বা লাফ দিতে পারা। অবশ্য উল্টো ঘটনাও ঘটে। যেমন বেশি ভয় পেয়েও দৌড়াতে না পারা।যা-ই হোক রিয়েলিটি চেক করা অভ্যাস করে ফেললে আপনি সহজেই স্বপ্ন ও বাস্তবতার ফারাক ধরে ফেলে ধীরে ধীরে লুসিড ড্রিম দেখতে পারবেন।
– আরেক উপায়ের নাম ওয়েক ব্যাক টু বেড বা জাগরণ থেকে বিছানায় প্রত্যাবর্তন টেকনিক*। এক্ষেত্রে ঘুম থেকে ওঠার স্বাভাবিক সময়ের প্রায় দুই ঘন্টা আগের সময়ে অ্যালার্ম দিয়ে রাখুন। এ সময় আমরা সাধারণত রেম (রেপিড আই মুভমেন্ট) ঘুমের মধ্যে থাকি। ঘুমের এই পর্যায়টি একটু দীর্ঘ ও গাঢ়। এলার্মের শব্দে জেগে উঠুন। প্রায় বিশ মিনিট পর আবার ঘুমিয়ে পড়ুন। এই বিরতির সময়ে সাম্প্রতিক ঘুমের স্মৃতি ভাবতে থাকুন বা বাকি অংশ লিখে রাখুন। সেটা এমন কিছু হলে ভালো হয় যেটা স্বপ্নকে বাস্তবতা থেকে আলাদা করতে সহায়ক হবে। এবার নতুন করে ঘুমিয়ে পড়লে আগের ঘুমের স্বপ্ন আবার শুরু হতে পারে।
– প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে এই কৌশলগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানো সম্ভব। কিছু অ্যাপ ও স্লীপ মাস্ক আছে যেগুলো অডিও এবং ভিজুয়াল সিগন্যালের মাধ্যমে আপনাকে লুসিড ড্রিমের জগতে নিয়ে যেতে পারে। তবে অ্যাপগুলো শুধু নির্দিষ্ট সময় পরপর অ্যালার্ম দিয়েই দায়িত্ব শেষ করবে। তাই মূল ভরসা রাখতে হবে নিজের প্রতিই।আর একবার নিয়মিত লুসিড ড্রিম দেখা শুরু করলেই স্বপ্নের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের চাবিও চলে আসবে আপনার হাতে!
লুসিড ড্রিমিং এর প্রয়োগঃ
লুসিড ড্রিম নিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান শুরু হওয়ার পরই নতুন চিন্তা শুরু হলো। এবার বিজ্ঞানীরা চিন্তা করলেন লুসিড ড্রিমকে মানব কল্যাণে ব্যবহার করার কথা। প্রাথমিকভাবে লুসিড ড্রিমকে ব্যবহার করে মানুষের বিভিন্ন মানসিক সমস্যা সমাধান করার কথা ভাবা হলো। অস্ট্রেলিয়ার স্বপ্ন বিশারদ ড. ডেনহোম এস্পি লুসিড ড্রিমকে মানসিক চিকিৎসায় ব্যবহার করার কথা বলেন। বিশেষ করে, যারা ক্রমাগত দুঃস্বপ্ন দেখার সমস্যা ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার বেশ ফলপ্রসূ। তিনি রোগীদের থেরাপির মাধ্যমে দুঃস্বপ্নকে লুসিড ড্রিমে পরিণত করার প্রশিক্ষণ দেন। এরপর তাদের স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সমস্যা দূর করার চেষ্টা করা হয়।
এছাড়া বিভিন্ন বস্তু এবং অবস্থার প্রতি ভয় বা ফোবিয়া যাদের কাজ করে, তাদের জন্য লুসিড ড্রিম থেরাপি ব্যবহারের কথা উঠেছে। স্বপ্নে কাউকে বারবার তার ফোবিয়ার মুখোমুখি করে ভীতি কাটিয়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন ড. এস্পি। তবে এসবের বাইরে কেউ স্রেফ আগ্রহ বা বিনোদনের উদ্দেশ্যেও লুসিড ড্রিম উপভোগ করতে পারে।
লুসিড ড্রিম অনেকটা ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির স্বাদ দেবে আপনাকে। যারা লুসিড ড্রিমে দক্ষ, তারা ইচ্ছে করলেই স্বপ্নকে অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। অনেকের কাছে লুসিড ড্রিম সিনেমা বা গল্পের মতো উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে। তবে এক্ষেত্রে আপনি নিজে থাকবেন চালকের আসনে। গল্পের কাহিনী আবর্তন করবে আপনার খেয়াল খুশিমতো।এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ বাড়াতে ,খেলাধুলায় ভালো করতে , পড়াশোনায় ভালো করতে , কোনও কিছুতে মনোযোগ বৃদ্ধি সহ ইত্যাদি কাজে লুসিড ড্রিমিং ব্যবহার করা যায়।
লুসিড ড্রিমের কিছু পার্শপ্রতিক্রিয়াঃ
লুসিড ড্রিমের বিনোদন আর অ্যাডভেঞ্চারে মত্ত হওয়ার আগে এর কিছু অপকারিতা সম্পর্কে আপনার ধারণা রাখা প্রয়োজন। যদিও লুসিড ড্রিমকে নিরাপদ ধরা যায়, তবে যাদের মানসিক অসুস্থতা বা কোনো সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য এটি ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। লুসিড ড্রিমের মধ্যে আপনাকে জেগে থাকতে হচ্ছে। এজন্য হয়তো আপনার ঘুমের প্রধান উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং ঘুমের অভাবে আপনার শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে পারে। বিষণ্ণতা এবং উৎকণ্ঠায় ভোগা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ঘুমের ব্যাঘাত মানসিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
যেহেতু আপনি স্বপ্নের মাঝেও জেগে আছেন, তাই স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে তালগোল লেগে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ব্যক্তি কোনটা বাস্তব আর কোনটা স্বপ্ন তা নির্ধারণ করতে হিমশিম খেয়ে যায়। এ ধরনের যেকোনো সমস্যা বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনে। তাই লুসিড ড্রিমের পূর্বে নিজের মানসিক স্থিরতা এবং বিশ্রাম নিয়ে কোনো কার্পণ্য করা যাবে না।
পরিশেষে বলা যায়, স্বপ্ন সেই প্রাচীনকাল থেকে আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। যুগে যুগে বহু গুণীজনের স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশনাকে কাজে লাগিয়ে বড় আবিষ্কার করার কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। বাস্তবতা আমাদের ক্ষমতার উপর যে লাগাম টেনে ধরেছে, সেই লাগাম আমরা স্বপ্নজগতে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি। আর স্বপ্নের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি অধ্যায় হচ্ছে লুসিড ড্রিম। লুসিড ড্রিম একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা যা আমাদের নতুন কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে। লুসিড ড্রিমকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে মানুষের মঙ্গল করা যায়, এ নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গবেষণা চলছে। হয়তো লুসিড ড্রিম আমাদের ভবিষ্যতে নতুন কোন সম্ভাবনার জন্ম দেবে। তবে এসব বিচারের বাইরে লুসিড ড্রিম সবসময় অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে সমাদৃত হবে। ভালোমন্দ বিচারের পরে যদি আপনি স্বপ্নের মধ্যেও অ্যাডভেঞ্চার করতে চান, তাহলে লুসিড ড্রিমের জগতে আপনাকে স্বাগতম।