ইন্টারনেট বা আন্তর্জাল, এমন এক প্রযুক্তি যার ওপর আমাদের দৈনন্দিন জীবন অনেকাংশেই নির্ভরশীল। প্রযুক্তির এই আমূল পরিবর্তনে জীবনযাত্রা সহজ থেকে সহজতর হয়ে উঠেছে। জিনিসপত্রের বিকিকিনি থেকে শুরু করে বহুদূরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ সবটাই আজ জলভাত। কিন্তু প্রশ্ন হল, এহেন আন্তর্জালের কতটুকু আমাদের জানা? কতটুকুই বা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত? সেখানে আছে কি এমন কোনও অংশ যেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ? এইসব প্রশ্নের উত্তর জানবার আগে চট করে একবার বুঝে নেওয়া যাক এই ইন্টারনেট বা আন্তর্জাল কী?
সহজ কথায় পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত দুই বা তার বেশি কম্পিউটারের নেটওয়ার্ক-ই হল ইন্টারনেট, যার মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করা যায়। ১৯৬০ সালে মার্কিন সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ আরপা (ARPA) প্রথমবার এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কয়েকটি কম্পিউটারের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে এই প্রযুক্তি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার ইন্টারনেট এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব এক জিনিস নয়, তবে সে প্রসঙ্গে না যাওয়াই ভাল।
ইন্টারনেটকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। সারফেস ওয়েব এবং ডিপ ওয়েব।
সারফেস ওয়েব, ইন্টারনেটের এই ভাগটির সঙ্গেই আমরা সবাই পরিচিত। গুগল (Google) সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে অনায়াসেই সারফেস ওয়েব ব্যবহার করা যায়। এটি সমগ্র ইন্টারনেট দুনিয়ার মাত্র পাঁচ শতাংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে।
তা হলে, প্রশ্ন হল ইন্টারনেট দুনিয়ার বাকি পঁচানব্বই শতাংশ জায়গা জুড়ে কী রয়েছে?
ইন্টারনেটের এই প্রায়-লুকানো এবং দুর্গম অংশটির পোশাকি নাম ডিপ ওয়েব। সঠিক ঠিকানা (URL) জানা না থাকলে কোনও সার্চ-ইঞ্জিন এই সাইটগুলি খুলতে পারে না। কিছু কিছু সাইট খোলার জন্য প্রয়োজন হয় বৈধ পাসওয়ার্ড এবং মেম্বারশিপ আইডি। এখন কথা হল, এই ধরনের কনফিডেন্সিয়াল সাইটগুলি কারা বানাল? কেনই বা বানাল?
এই প্রশ্নের উত্তর বুঝতে হলে প্রথমেই খেয়াল রাখতে হবে ইন্টারনেট হল একটি নেটওয়ার্ক, যেখানে আপনি-আমি একা নই। রয়েছে লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারী। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোটোকল (ISP) নামের একটি সিস্টেম প্রত্যেক ব্যবহারকারীর ওপর নজরদারির কাজটি করে। এমতাবস্থায়, নানান সময় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী গ্রুপগুলি এমন একটি ব্যবস্থার প্রয়োজন বোধ করে যেখানে তার ওপর কোনও নজরদারি থাকবে না। বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠন, হ্যাকার গোষ্ঠী, গোয়েন্দা ও সামরিক বিভাগের নথি এবং তথ্য সংরক্ষণ, আদান-প্রদানকে সুগম করতেই ডিপ ওয়েবের জন্ম।
এবার প্রশ্ন হল, গুগলের মত সার্চ-ইঞ্জিনগুলো কেন ডিপ ওয়েব সার্চ করতে পারে না? আসলে সার্চ-ইঞ্জিনগুলো একরকম ভার্চুয়াল রোবটের মাধ্যমে কাজ করে যার নাম Crawler। এখন যে সকল ব্যক্তি চান না তাদের ওয়েবসাইট সারফেস ওয়েবে থাকুক তারা এই Crawler-গুলিকে ব্লক করে দেন ফলে ওয়েবসাইটটি খুঁজে বের করা যায় না।
• ডার্ক ওয়েব – ডিপ ওয়েব যখন মূলত নথিপত্র সংরক্ষণ, সামরিক ব্যবস্থার গোপনীয় তথ্যের নিরাপদ আদান-প্রদান, গোপন গবেষণা, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ওপর বেলাগাম সরকারি নজরদারি থেকে মুক্তির মত কয়েকটি আপাত নিরীহ এবং কার্যকরী বিষয়কে মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছিল; ঠিক তখন, অপরাধের পথ সুগম ও মসৃণ করার জন্য আরেকটি বিকল্প ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। এই অংশটির নাম ডার্ক ওয়েব (Dark Web)। এটি ডিপ ওয়েবের একটি অংশ মাত্র, যদিও অনেকেই একে ডিপ ওয়েবের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। এখানে পৌঁছনো আরও কিছুটা কঠিন। এর জন্য টর, আইটুপি-এর মত কিছু নির্দিষ্ট সফটওয়্যার প্রয়োজন। তা ছাড়া, এইসব সাইটগুলির অ্যাড্রেসগুলি ষোলোটি অ্যালফাবেট এবং নাম্বার মিলিয়ে (যেমন – s98kj9u7fhk82gh7.onion) এমন ভাবে বানানো হয় যাতে মানুষের পক্ষে মনে রাখা খুব কঠিন।
ডার্ক ওয়েবের অন্তর্ভুক্ত ওয়েবসাইটগুলি অধিকাংশই অপরাধসংক্রান্ত। বিভিন্ন হ্যাকার গোষ্ঠী এবং ইলুমিনাটি, স্কাল অ্যান্ড বোন্স, আইসিসের মত গুপ্ত সংগঠনগুলি এখানে অতিসক্রিয়। তা ছাড়া ড্রাগ কেনাবেচা, অস্ত্র কেনাবেচা, শিশু পর্ণোগ্রাফি, নির্যাতন এবং খুনের সরাসরি সম্প্রচার, বিকৃত যৌনাচার – সবকিছুর এখানে রমরমা। ড্রাগ কেনাবেচার সবথেকে বড় মার্কেট (Silk Roard 3.0) ডার্ক ওয়েবের অংশ। এখানেই শেষ নয়, কিছু সাইট থেকে সরাসরি হিটম্যানও (কিলার) ভাড়া পাওয়া যায়।
সব শেষে যে প্রশ্নটা মনে আসে, এই ধরণের ওয়েবসাইটগুলি কারা বানায়? এদের ব্যবহারকারীই বা কারা? কেন এই ধরনের ওয়েবসাইটগুলি বন্ধ করে দেওয়া যায় না?
প্রথমেই এটা বুঝে নেওয়া ভাল, ডার্ক ওয়েবের বেশিরভাগ ওয়েবসাইটই ব্যক্তিগত স্বার্থে বানানো হয়। কঠিন অ্যাড্রেসের কারণে খুঁজে বের করা এমনিতেই বেশ শ্রমসাধ্য। তার ওপর ডার্ক ওয়েব এমন এক পদ্ধতিতে তথ্য আদান-প্রদানের কাজটি করে যাতে একমাত্র তথ্য প্রেরক এবং তথ্য প্রাপক ছাড়া কেউই তা ডি-কোড করতে পারে না। ফলে, নজরদারি চালানোর কাজটি আরও কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও আশার কথা, বিগত কয়েক বছরে টেক-পুলিশের সহায়তায় বেশ কিছু ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয়েছে। ধরা পড়েছে একাধিক ডার্ক ওয়েব অপরাধি।
সব শেষে জানিয়ে রাখি ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এবং হ্যাকিং-এ এই ছদ্মবেশী নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীদের জুড়ি মেলা ভার। ফলে কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে, অসাবধান হলেই কম্পিউটারের সমস্ত তথ্য চুরি যেতে পারে। রয়েছে আরও নানান বিপদের সম্ভাবনা। ফলে এই ধরনের ওয়েবসাইটে প্রবেশ না করাই ভাল।