কাতার
বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশ কাতার। এই দেশটিই বর্তমানে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ধনী। কাতারের মাথাপিছু আয় প্রায় ৭২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। মধ্যপ্রাচ্যের উপদ্বীপ কাতারের অর্থনীতি জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। দেশটির রপ্তানি থেকে আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে পেট্রোলিয়াম রপ্তানি করে।
কাতারে খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় মজুদ আছে। এই প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে দেশটির অর্থনীতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তও এটি একটি তুলনামূলকভাবে দরিদ্র দেশ ছিল। ঐ সময় দেশটিতে পেট্রোলিয়ামের মজুদ আবিষ্কৃত হয় এবং এগুলি উত্তোলন শুরু হলে অবস্থা পাল্টে যেতে থাকে। কাতারের নাগরিক সুযোগ সুবিধার মান খুবই উন্নত।
লুক্সেমবার্গ
ইউরোপের সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর অন্যতম লুক্সেমবার্গকে বলা হয় ‘tax heaven’ বা ‘করের স্বর্গ’। পশ্চিম ইউরোপের ক্ষুদ্রায়তন এই দেশটির বর্তমান মাথাপিছু আয় প্রায় ৬৭ লাখ টাকা।
লুক্সেমবার্গ ইউরো অঞ্চলভুক্ত একটি দেশ; তাই এখানকার প্রচলিত মুদ্রা হলো ইউরো। এটি পৃথিবীর অন্যতম ধনী একটি দেশ।
লুক্সেমবার্গের আয়তন ২,৫৮৬ বর্গকিলোমিটার। ২০১২ সালের হিসাবে লুক্সেমবার্গের গ্রোস ডোমেসটিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) হলো ৫৭ দশমিক ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। লুক্সেমবার্গের প্রধান আয়ের উৎস হলো ব্যাংকিং খাত। এই ছোট্ট রাষ্ট্রটিতে ২৫০টির বেশি ব্যাংক আছে। এখানকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইউরোপীয় দেশগুলোসহ বিশ্বের মধ্যে সেরা। এ দেশের জনগণকে খুব বেশি স্মার্ট হিসেবে গণ্য করা হয়। লুক্সেমবার্গ ট্যাক্স-হেভেন বা করের-স্বর্গ নামে সুখ্যাত।
সিঙ্গাপুর
ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি থেকে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র হয়েছে সিঙ্গাপুর। ৬৩টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা মাত্র ৫৫ লাখ আর মাথাপিছু আয় ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। এশিয়ার দেশগুলোর পারস্পরিক ব্যবসা-বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে নগরায়িত দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। তেমন কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য করেই বর্তমানে এই অবস্থানে এসেছে দেশটি।
১৮৬৯ সালে সুয়েজ ক্যানাল খোলার পর ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে সমুদ্র বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়, ঠিক তখনই সিঙ্গাপুরকে বিশ্বের প্রধান সমুদ্র বন্দর হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র হচ্ছে সিঙ্গাপুর। অথচ ১৯৬৫ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের বছরে এই দেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৫১৬ মার্কিন ডলার। এই ৫১৬ ইউ.এস. ডলার ছিল তখন পূর্ব এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। স্বাধীনতার পরে ইউরোপ থেকে বিনিয়োগ আসার মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হওয়া শুরু করে। আশির দশকের মাঝখান দিকে এই দেশটি উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। পর্যটন সিঙ্গাপুরের অন্যতম প্রধান শিল্প এবং দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখে। প্রতিবছর কয়েক মিলিয়ন পর্যটক সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করে।
নরওয়ে
বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ নরওয়ে। নরওয়ের জিডিপি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেশটিকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করে তুলেছে। দেশটি উত্তরমেরুতে হওয়াতে আবহাওয়া শীতল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও চমৎকার। দেশটির মানুষের মেজাজও ঠাণ্ডা। তাই দেশটি সবাচেয়ে সুখী। দেশটির অবকাঠামো, প্রযুক্তির উন্নয়ন, ইতিবাচক পররাষ্ট্রনীতি ও ধর্মীয় স্বাধীনতাও সুখী হওয়ার পিছনে কাজ করেছে।
নরওয়ের ৮৬ শতাংশ মানুষ রাতের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন না। মাত্র ৫০ লাখ জনসংখ্যার নরওয়ের আয়ের অন্যতম উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিশাল তেল ভাণ্ডার। বিশ্বব্যাপী টেলিযোগাযোগ ব্যবসাতেও নরওয়ে বেশ সফল। বিপুল প্রাচুর্যের পাশাপাশি বসবাসের জন্য সারা বিশ্বে সবচেয়ে নিরাপদ দেশ হিসেবে পরিচিত নরওয়ে। দেশটির মাথাপিছু আয় ৪২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা।
ব্রুনাই
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম ধনী দেশ ব্রুনাইয়ের মাথাপিছু বার্ষিক আয় প্রায় ৩৯ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস দেশটির আয়ের প্রধান উৎস। দেশটির জিডিপির ৯০ শতাংশের জোগান দেয় পেট্রোলিয়াম রপ্তানি করে। পাঁচ লাখের কম জনসংখ্যার দেশটি বিশ্বে সবচেয়ে কম জনবহুল দেশগুলোর একটি। ব্রুনাই তেল সম্পদে সমৃদ্ধ একটি ধনী রাষ্ট্র। মালয় ভাষা দেশটির সার্বজনীন ভাষা বা লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা, তবে ইদানীং পর্যটন ও বাণিজ্যে ইংরেজি ভাষার প্রসার বেড়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
সাতটি স্বাধীন প্রদেশের সমন্বয়ে গঠিত বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির বার্ষিক মাথাপিছু আয় প্রায় ৩৯ লাখ টাকা। প্রাকৃতিক গ্যাস, জ্বালানি তেল ও খেজুরের মতো প্রচলিত পণ্য রপ্তানির পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণেও ভালো অবস্থানে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।
সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় অবস্থিত সাতটি স্বাধীন রাষ্ট্রের একটি ফেডারেশন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাতটি আমিরাতের নাম হল আবু ধাবি, আজমান, দুবাই, আল ফুজাইরাহ, রাআস আল খাইমাহ, আশ শারিকাহ এবং উম্ম আল ক্বাইওয়াইন। আবুধাবি শহর ফেডারেশনের রাজধানী এবং দুবাই দেশের বৃহত্তম শহর। খনিজ তেল শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে এগুলোর দ্রুত উন্নতি ও আধুনিকায়ন ঘটে। দেশের খনিজ তেলের বেশির ভাগ আবুধাবিতে পাওয়া যায়, ফলে এটি সাতটি আমিরাতের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ও শক্তিশালী। তেল শিল্পের কারণে এখানকার অর্থনীতি স্থিতিশীল এবং জীবনযাত্রার মান বিশ্বের সর্বোচ্চগুলোর একটি।
হংকং
এশিয়াসহ সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের কাছেই পছন্দের দেশ হংকং। এশিয়ার অন্যতম ব্যয়বহুল দেশ হংকংয়ের মাথাপিছু আয় ৩৭ লাখ ৮২ হাজার টাকা। বহুজাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মার্সারের তৈরি করা বিশ্বের ১০টি ব্যয়বহুল শহরের তালিকায় শীর্ষ স্থানে রয়েছে হংকং। হংকংয়ের অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী।
হংকংকে বলা হয় ‘ক্রীড়াশীল পুঁজিবাদের মন্দির’। লন্ডন ও লস এ্যাঞ্জেলেসে একত্রে যত বিলিয়নিয়ার আছে ততজন বিলিয়নিয়ার আছে শুধু হংকংয়ে। হংকং এমন এক নগরী যেখানে দীর্ঘদিন ধরে শাসকশ্রেণী হয় এমন সব ধনকুবের কিংবা আমলাদের নিয়ে গঠিত যারা যে কারও কর্তৃত্বের অনুগত। আগে ছিল ব্রিটেনের এখন মূলচীনের।
নেদারল্যান্ড
প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ ইউরোপ মহাদেশের নেদারল্যান্ড্স প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করে তার আয়ের সিংহভাগ উপার্জন করে। নেদারল্যান্ডের মাথাপিছু আয় প্রায় ৩৩ লাখ ৭২ হাজার টাকা।নেদারল্যান্ডস বারটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। এদরকে প্রভিয়েন্স বলা হয়। প্রত্যেকটি প্রভিয়েন্স একজন গর্ভনর দ্বারা শাসিত, যাকে কমিশনার অব দ্য কুইন বা কমিস্যারিস ভ্যান দ্য কোনিগিন বলা হয়। শুধু মাত্র লিমবার্গ প্রভিয়েন্সের প্রধানকে গর্ভনর বলা হয়। প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিউনিসিপালিটিসে বিভক্ত। ২০১০ সালের হিসেবে ৪৩০টি প্রভিয়েন্স আছে। নেদারল্যান্ডস ইউরোপের ১১তম বৃহৎ জনসংখ্যা সমৃদ্ধ ও পৃথিবীতে ৬১ তম দেশ। নেদারল্যান্ডসের প্রধান ধর্মগুলি হল খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির আয়ের সিংহভাগ আসে উচ্চ প্রযুক্তি, অস্ত্র রফতানি থেকে। দেশটির মাথাপিছু আয় ৩৮ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ১৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্ব অর্থনীতির ২৪ দশমিক তিন শতাংশ অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে দেশটি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আয়তন ৩.৭৯ মিলিয়ন বর্গমাইল। দেশের জনসংখ্যা প্রায় ৩০৯ মিলিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বৈচিত্র্যমণ্ডিত বহুজাতিক সমাজব্যবস্থা। বহু দেশ থেকে বিভিন্ন জাতির মানুষের অভিনিবেশের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ একটি বহুসংস্কৃতিবাদী দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিশ্বের বৃহত্তম জাতীয় অর্থনীতি।
সুইজারল্যান্ড
বিশ্বের পর্যটকদের জন্য ইউরোপের অন্যতম ধনী দেশ সুইজারল্যান্ড বিশেষ আকর্ষণীয় একটি দেশ। আল্পস পর্বতমালা ও প্রশস্ত হ্রদ সুইজারল্যান্ডকে অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে-রূপে ভূষিত করেছে। ইউরোপ দেশগুলোর মধ্যে সুইজারল্যান্ড সবচেয়ে সৌন্দর্যময় দেশ। সুইজারল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইউরোপের সব দেশকে হার মানায়। পাহাড়, পর্বত, লেক, ভ্যালি এবং এ্যালপাইন বনাঞ্চল ঘেরা এই দেশটিকে সৃষ্টিকর্তা যেন সব কিছু উজাড় করে দিয়েছেন।
বের্ন শহরটি সুইজারল্যান্ডের রাজধানী। অন্যতম বিখ্যাত অন্য দু’টি শহর হলো জুরিখ এবং জেনিভা। জুরিখের দিকের লোকেরা জার্মান এবং জেনিভার দিকের লোকেরা ফরাসি ভাষায় কথা বলে। সুইজারল্যান্ডের ঘড়ি, ট্রেন এবং চকলেট খ্যাতি বিশ্বজোড়া। দেশটির কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনী নেই। দেশটির রাজনৈতিক অবস্থা ভারসাম্যমূলক। সুইজারল্যান্ডে মোট ২৬টি ক্যান্টন রয়েছে। ঐতিহাসিক কনফেডারেশনের সময় এর প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল যাদের পৃথক সীমানা ও রাষ্ট্রব্যবস্থাও ছিল। বর্তমানে এর সবগুলো সুইজারল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত।
সূত্র : ফোর্বস, টাইম, কাতার এয়ারওয়েজ, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, বিজনেস ইনসাইডার ও উইকিপিডিয়া