ইলিশ মৌসুম শুরু না হতেই দস্যুর উৎপাত

ইলিশ মৌসুম শুরু হতে না হতেই ভোলায় মেঘনা নদীতে জলদস্যুর উৎপাত বেড়েছে। জেলেরা দস্যুর ভয়ে মেঘনা-তেঁতুলিয়া ও সাগর মোহনায় মাছ ধরতে যেতে পারছেন না।
জেলেরা জানান, একসময় দস্যুরা জেলেদের নদীতে ফেলে রেখে মাছ ধরা নৌকা-মালামাল লুট করত। পরে মোটা চাঁদার বিনিময়ে সেই নৌকা ছাড়িয়ে আনতেন তাঁরা। এখন দামি মালামালের সঙ্গে জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে তারা। ওই মুক্তিপণ নিচ্ছে মোবাইল ফোন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৫০ জন জেলে জানান, গত জুন থেকে মাছ ধরা মৌসুম শুরু হয়েছে। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রতিদিন ২-১০ হালি মাছ পাচ্ছেন জেলেরা। মাছের দাম বেশি হওয়ায় জেলেরা পুষিয়ে নিতে পারছেন। সমস্যা দাঁড়িয়েছে জলদস্যু। অস্ত্রের মুখে মাছ ধরার নৌকা ধাওয়া করছে। মালামাল লুটের সঙ্গে জেলেদের অপহরণ করছে। ফলে ভোলার দুই লাখ জেলের অর্ধেক দস্যুর ভয়ে জলে নামছেন না।
অপহৃত জেলেরা জানান, দস্যুরা তাঁদের নৌকার বরফের বাক্সের মধ্যে, গহিন জঙ্গলে গাছের সঙ্গে, বিরান চরের ঘরে মাটির গর্ত করে তার মধ্যে হাত-পা বেঁধে আটকে রাখে। ঠিকমতো খেতে দেয় না। মারধর করে স্বজনের কাছে ফোন করতে বলে। হত্যার হুমকি দেয়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে নখ তুলে ফেলে। জেলের পরিবার বাধ্য হয়ে সুদের ওপর ঋণ করে, গরু-ছাগল ও গয়না বিক্রি করে দস্যুর মোবাইলে টাকা পাঠায়। সেই টাকা পেয়ে জেলেকে ছেড়ে দেয়। জেলেরা বলেন, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোককে জানালে নির্যাতন বেড়ে যায়।
জেলেরা আরও জানান, জুন-জুলাইয়ে দৌলতখান উপজেলার বিভিন্ন মাছঘাটের ১২টি নৌকা, তজুমদ্দিন উপজেলায় ৮টি, বোরহানউদ্দিন উপজেলায় ২টি ও মনপুরা উপজেলায় ২৩টি ট্রলারসহ ৪৫টি মাছ ধরা নৌকার ৫৫ জন জেলে অপহৃত হয়েছেন। এসব জেলেকে ২০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছে পরিবার।
মনপুরা উপজেলার কয়েকজন জেলে বলেন, হাতিয়ার জলদস্যু কৃষ্ণা, বাবু এবং কালাম বাহিনী মেঘনার বিভিন্ন চরে অবস্থান নিয়ে জেলেদের ওপর হামলা করছে। তাদের সহায়তা করছে ভোলার রাঘব বোয়ালরা। বিগত সময়ের মতো দস্যুরা মেঘনায় মাছ শিকারের জেলেদের টাকা দিয়ে টোকেন কার্ড সংগ্রহের হুমকি দিচ্ছে।
দৌলতখান পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মৎস্য ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, নদীতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো অভিযান নেই। তাঁদের এখন দ্রুতগামী নৌযান আছে। সেটিতে রাতে ও ভোরে সাইরেন বাজিয়ে টহল দিলেই ভয়ে দস্যু আক্রমণ করবে না।
ভোলা সদর উপজেলার তুলাতুলি মাছঘাটের আড়তদার আব্দুল খালেক বলেন, ভোলা সদর উপজেলার মেঘনায় অনেক দিন পর আবার দস্যুর উপদ্রব বেড়েছে। চরফ্যাশন সামরাজ মাছঘাটের আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিম বলেন, দস্যুর ভয়ে জেলেরা মাছ ধরতে যেতে পারছেন না। মাছ কম পড়ায় ঝুঁকি নিচ্ছেন না। বেকার বসে আছেন জেলেরা।
মনপুরা উপজেলার জনতাবাজার মাছঘাটের আড়তদার বলেন, দস্যুর ভয়ে আইন প্রয়োগকারীদের ট্রলার, তেল, খাওয়া খরচ দিয়ে টহলে নামাতে হয়েছে।
উপজেলার রামনেওয়াজ মাছঘাটের মো. মমিনসহ একাধিক আড়তদার বলেন, দস্যুরা সবাই পূর্ব পাড়ের। পশ্চিম পাড় থেকে ধাওয়া করলে পূর্ব পাড়ে আশ্রয় পায়। দস্যু নির্মূলে ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রামের প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারীদের একত্রে কাজ করতে হবে।
ভোলার পুলিশ সুপার মো. মোকতার হোসেন বলেন, তাঁরা জলদস্যু প্রতিরোধে নিয়মিত টহলে আগ্রহী, কিন্তু পর্যাপ্ত খরচ, জলযান ও লোকবল সংকট। তারপরও টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলীয় কোস্টগার্ডের অপারেশন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার সৈয়দ সাজ্জাদুর রহমান একই সমস্যা উল্লেখ করে বলেন, জলদস্যু দমনে তাঁরা সব বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ অভিযান চাচ্ছেন। জেলা প্রশাসক মোহাং সেলিম উদ্দিন বলেন, মেঘনা ও সাগর মোহনায় জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।