মাদারীপুরের সদর উপজেলার মস্তফাপুরে গতকাল শুক্রবার একটি সুতা তৈরির কারখানা (স্পিনিং মিল) সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে একজন শ্রমিক পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। তা ছাড়া, পুলিশসহ আরও ১৫ জন আহত হয়েছেন। বেলা দেড়টার দিকে কারখানার ভেতরে এই সংঘর্ষ হয়।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুর স্পিনিং মিলস লিমিটেড নামের কারখানা কর্তৃপক্ষ রূপালী ব্যাংক মতিঝিল শাখা থেকে ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। প্রতিষ্ঠানটি সময়মতো ঋণের টাকা পরিশোধ করেনি। এ কারণে গত বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটিকে সিলগালা করার নির্দেশ দেয় সরকার। এই পরিপ্রেক্ষিতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ফিরোজ হোসেনসহ একটি দল সেখান যায়। কিন্তু দলটি কারখানা সিলগালা করতে গেলে শ্রমিকেরা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করেন। সেখান থেকে পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দিলে কারখানার ভেতরে অবস্থান নেয়। পরে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় মো. জাহাঙ্গীর (৩৫) নামের ওই শ্রমিকের পায়ে রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়। তাঁর বাড়ি মস্তফাপুর এলাকায়। এ ছাড়া অন্য দুই নারী শ্রমিক ও কারখানার এক কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। তাঁদের সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তার নাম আমিনুর ইসলাম। তিনি সংঘর্ষ চলাকালে লাঠির আঘাতে মাথায় রক্তাক্ত জখম হয়েছেন। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
শ্রমিকেরা বলেন, তাঁদের দুই মাস ১৫ দিনের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়নি। এরই মধ্যে কারখানাটি সিলগালা করা হয়। এতে শ্রমিকেরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। বিশেষ করে দুই হাজারের বেশি নারী শ্রমিক মহাবিপদে পড়েছেন।
নেহারী দত্ত নামের একজন নারী শ্রমিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিনের মতো আজও আমরা মিলে কাজ করতে আসি। তারপরই শুনি প্রশাসনের লোকেরা এসেছে মিল বন্ধ করে দিতে। আমরা গরিব মানুষ। কাজ করে খাই। মিলটি বন্ধ হয়ে গেলে আমরা বাঁচমু কী খাইয়া? এ জন্য বিক্ষোভ করি।’
রাজিয়া বেগম নামে আরেকজন নারী শ্রমিক বলেন, ‘আমরা এখানে পেটের দায়ে কাজ করি। মিলটি বন্ধ হয়ে গেলে আমাগো পোলা-মাইয়ার কী হবে? ওগো লেখাপড়ার টেকা কেডা জোগাড় কইরা দিবে?’
আমিনুর ইসলাম নামের একজন শ্রমিক বলেন, ‘মিলটির সঙ্গে আমাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ জড়িত। কারণ, এখানের আয়–রোজগার দিয়া আমরা সংসার চালাই। এই প্রতিষ্ঠান থেকে এখানে আমাদের দুই মাসের বেতনও দেয়নি।’
মাদারীপুর স্পিনিং মিলস লিমিটেডের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আবদুল রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের মিলের পরিচালক কিশোরগঞ্জের ভৈরবের ইউসুফ বাবু চিকিৎসার জন্য বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন। তিনি দেশে ফিরলেই কারখানাটি চালু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। শ্রমিকদের বকেয়া বেতন দেওয়ার বিষয়েও আলোচনা করা হচ্ছে।’
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ফিরোজ হোসেন বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করতে গেলে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমরা কারখানাটি সিলগালা করেছি। কারখানা কর্তৃপক্ষ যদি দেনা পরিশোধ করে, তাহলে আবার তা চালু করতে পারবে।’
অতিরিক্ত সচিব আরও বলেন, এই কারখানা চালু হয় ১৯৭৮ সালে। ১৯৯৩ সালে সরকারের কাছে থেকে বিভিন্ন চুক্তিতে মালিকপক্ষ এটি কিনে নেয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও চুক্তিতে থাকা অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি কারখানা কর্তৃপক্ষ। রূপালী ব্যাংকের ঋণের টাকা ও পাট মন্ত্রণালয়ের চুক্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারায় সিলগালার এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমন কুমার দেব বলেন, ‘প্রথমে শ্রমিকদের বুঝিয়ে আমরা সরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। শ্রমিকেরা আমাদের ওপর ইটপাটকেল ছোড়েন। পরে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে আমরা লাঠিপেটা করি। এতে কয়েকজন আহত হন।’ তিনি আরও বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ চার-পাঁচটি রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের ছয়টি শেল নিক্ষেপ করে। তবে কেউ গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
মাদারীপুরে পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষ, একজন গুলিবিদ্ধসহ আহত ১৬
