এখন নওয়াজের কী হবে?

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পর পদত্যাগ করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। আজ শুক্রবার আদালতের রায়ের পরপরই পদত্যাগ করেন তিনি। এখন এই সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে শুরু হয়ে গেছে আলোচনা। তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে ফিরে আসতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়।
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে নওয়াজ শরিফের নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ যেমন কালো মেঘে ঢেকে গেছে, তেমনি শঙ্কায় পড়েছে তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যৎও। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে এখন জড়ানো হবে নওয়াজের মেয়ে মরিয়ম নওয়াজকে। পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির সংস্কৃতিতে মরিয়মকে ভাবা হচ্ছিল পিএমএল-এনের পরবর্তী নেতৃত্ব হিসেবে। যৌথ নিরাপত্তা দল (জেআইটি) সুপ্রিম কোর্টে প্রস্তাব করেছিল, যেন তাদের সংগ্রহ করা প্রমাণাদি আদালতের অধীনে রাখা হয়।

সুপ্রিম কোর্ট এ প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এর ফলে নওয়াজের সন্তানদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে মরিয়ম ও তাঁর পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যেই এই মামলা করা হতে পারে। যদি এই মামলার রায় বিপক্ষে যায়, তবে উত্তরসূরি নির্বাচন নিয়ে নওয়াজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা পুরোপুরি ভন্ডুল হয়ে যাবে।

তবে এর চেয়ে এখন নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন নিয়েই বেশি চিন্তায় আছেন নওয়াজ। জাতীয় পরিষদে এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ পিএমএল-এনের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট। ৩৪২টি আসনের মধ্যে ২০৯টি আসন আছে এই জোটের দখলে। সেই হিসেবে ২০১৮ সালে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবে দলটি।

দলের নেতৃত্ব এখনো হাতে থাকায় নওয়াজের ওপরেই আছে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের কর্তৃত্ব। নওয়াজ তাই একজন বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিকে বেছে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। যেন সেই মনোনীত ব্যক্তি দল ও সরকারে তাঁর পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তিতে কোনো কাটছাঁট না করেন! সুতরাং নিজের পরিবার থেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে নিলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আবার তাঁর নতুন প্রধানমন্ত্রীকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কীভাবে নেয়, সেটিও দেখার বিষয়।

অবশ্য আদালত কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার ঘটনা পাকিস্তানে প্রথম নয়। ২০১২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল আদালত। তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ ছিল। কারণ, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা পুনরায় চালু করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তিনি।

এখন প্রশ্ন উঠছে, নওয়াজ সুপ্রিম কোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন কি না। তাত্ত্বিকভাবে উত্তর দিলে, পারবেন। কিন্তু তা প্রায় অসম্ভব। পাকিস্তানের সংবিধানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আইনজীবী ইয়াসির লতিফ হামদানি বার্তা সংস্থা আল জাজিরাকে বলেন, ‘সংবিধানবিষয়ক যেকোনো বিষয়ের চূড়ান্ত সালিস, মীমাংসা ও ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকেন সুপ্রিম কোর্ট। সুতরাং আদালত যা বলবেন, যেভাবে নির্দেশ দেবেন, তার বাইরে বাস্তবে কিছু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।’

আগাম নির্বাচনের ডাক দেওয়া হবে কি না, সেটি নিয়েও জল্পনা-কল্পনা চলছে। কিন্তু পাকিস্তানের সংবিধান অনুসারে আগাম নির্বাচনের ডাক দেবেন প্রেসিডেন্ট। এর জন্য আবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন তিনি। তাই আগাম নির্বাচনের ডাক দিতে চাইলেও আগে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে হবে।
সামরিক বাহিনী আবার ক্ষমতায় আসবে কি না, সেটি কোটি টাকার প্রশ্ন। দেশটির ৭০ বছরের ইতিহাসের প্রায় অর্ধেক সময়ই রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল সামরিক বাহিনী। বর্তমান ব্যবস্থায় পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষাবিষয়ক সিদ্ধান্ত প্রণয়নের এখতিয়ার আছে সামরিক বাহিনীর। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের এশিয়াবিষয়ক কর্মসূচির উপপরিচালক মাইকেল কুগলম্যান বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, পর্দার পেছন থেকে এখনই তারা অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতার স্বাদ ভালোভাবেই উপভোগ করছে। তা ছাড়া পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মনোভাব সামরিক আইন জারির বিরুদ্ধে।’

মাইকেল কুগলম্যান আরও বলেন, দেশটির সামরিক বাহিনী জনগণের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে চায়। আর এ কারণেই বিগত সময়ের মতো ক্ষমতার কেন্দ্রে হয়তো আসবে না তারা।
তবে নওয়াজের বিদায়ে কে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন, এর উত্তর খুঁজতে মোটেও বেগ পেতে হচ্ছে না। তিনি হলেন তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের প্রধান ও সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান। পানামা পেপারস ইস্যুতে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় ছিলেন ইমরান। ২১ জুলাই যৌথ তদন্ত দলের প্রতিবেদনের ওপর আদালতে শুনানি শেষ হওয়ার পরই দ্রুত রায় প্রদানের আরজি জানিয়েছিলেন তিনি। জুলাইয়ের ২৫ তারিখ নওয়াজ শরিফের দুর্নীতি নিয়ে টুইট বার্তাও দেন ইমরান। সেই হিসেবে আদালতের আজকের রায়কে তাঁর রাজনৈতিক ও নৈতিক বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। আগামী বছরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে নিজের এই দুর্নীতিবিরোধী ভাবমূর্তি ইমরান কতটা কাজে লাগাতে পারবেন, তার ওপরই নির্ভর করবে পিটিআইয়ের ভাগ্য।

আল জাজিরা ও দ্য হিন্দু অবলম্বনে